প্রশ্ন: যিনি বলেন: এ যুগে মুসলমানদের দরিদ্রতা, দুর্বলতা ও পিছিয়ে থাকার কারণ হচ্ছে– অর্থনৈতিক অগ্রগতির তুলনায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও অধিক জন্মহার। আপনাদের দৃষ্টিতে এ ব্যক্তির ব্যাপারে শরয়ি হুকুম কি এবং তার প্রতি আপনাদের নসীহত কি?
যে ব্যক্তি বলেন: ‘মুসলমানদের দারিদ্রের কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি’ সে ব্যক্তির হুকুম কি?
প্রশ্ন: 119955
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
আলহামদুলিল্লাহ।
আমরা মনেকরি, তার এ দৃষ্টিভঙ্গিভুল। কারণ যারজন্য ইচ্ছা রিযিকেরসমৃদ্ধিদানকারীও সংকোচনকারী হচ্ছেনআল্লাহ তাআলা।অধিক জনসংখ্যারিযিক সংকোচনেরকারণ নয়। যেহেতুএ পৃথিবীতে যতপ্রাণী আছে সকলেররিযিকের ভার আল্লাহরউপরে। তবে, আল্লাহতাআলা কোন হেকমতেরকারণে রিযিক দেনএবং কোন হেকমতেরকারণে রিযিক থেকেবঞ্ছিত করেন।
যে ব্যক্তিএমন বিশ্বাস করেতার জন্য আমারনসীহত হচ্ছে- সেযেন আল্লাহকে ভয়করে এবং এ বাতিলবিশ্বাস ত্যাগকরে। সে যেন জেনেরাখে, এ বিশ্বজগতেরসদস্য যতই বৃদ্ধিপাক না কেন আল্লাহচাইলে তাদের সকলেররিযিকে সমৃদ্ধিদিতে পারেন। কিন্তুআল্লাহ তাআলা তাঁরকিতাবে বলেছেন,“যদি আল্লাহতাঁর বান্দাদেরকে রিযিকে সমৃদ্ধি দিতেন, তবেতারাপৃথিবীতেবিপর্যয়সৃষ্টি করত।কিন্তু তিনিযে পরিমাণইচ্ছা সেপরিমাণ নাযিল করেন।নিশ্চয় তিনিতাঁর বান্দা সম্পর্কেসম্যক জ্ঞাত ও সূক্ষ্মদর্শী।[সূরা শুরা,আয়াত: ২৭]
শাইখ মুহাম্মদবিন সালেহ আল-উছাইমীন
[ফাতাওয়াউলামায়িল বালাদিলহারাম, পৃষ্ঠা-১০৮৪]
কোন সন্দেহনেই জননিয়ন্ত্রণও জনসংখ্যা হ্রাসকরার প্রচারণানবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামেরনির্দেশের সাথেসাংঘর্ষিক। নবীসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামএর নির্দেশ হচ্ছে:“তোমরা প্রমময়ীও অধিক সন্তানপ্রসবানারীকে বিয়ে কর।কেননা আমি তোমাদেরসংখ্যাধিক্য নিয়েঅন্যান্য উম্মতেরওপর গর্ব করবো।[সুনানেআবু দাউদ, (২০৫০),আলবানী ‘ইরওয়াউলগালিল’ গ্রন্থে(১৭৮৪) হাদিসটিকেসহিহ আখ্যায়িতকরেছেন]
আল্লাহতাআলা সকল মাখলুকেররিযিক নিশ্চয়তাদানকারী। তিনিবলেন: “আর পৃথিবীতেবিচরণশীল যে কারোরিযিক আল্লাহরউপর” [সূরা হুদ, আয়াত:৬]
তাইজনসংখ্যা বৃদ্ধিরগতিরোধ করা; সেটাগর্ভ-নিরোধক বিভিন্নউপায় গ্রহণের মাধ্যমেকিংবা গর্ভপাতঘটানোর মাধ্যমেকিংবা অন্য কোনমাধ্যমে; এ বিশ্বাসথেকে যে, মজুদকৃতসম্পদ অতিরিক্তজনসংখ্যার জন্যযথেষ্ট নয়, কিংবাজনকল্যাণের দাবীহচ্ছে- জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমানো;নিশ্চয় এটি আল্লাহররুবুবিয়্যত (প্রতিপালকত্ব)ও তাঁর রিযিকেরপ্রশস্ততাকে অস্বীকারকরার নামান্তর।এটি মুশরিকদেরবিশ্বাসের সাথেসাদৃশ্যপূর্ণ;যারা দারিদ্রেরভয়ে তাদের সন্তানদেরকেহত্যা করত। আল্লাহতাআলা বলেন: “দারিদ্রেরকারণে সন্তানদেরকেহত্যা করো না, আমিতোমাদেরকে ও তাদেরকেরিযিক দেই।”[সূরাআনআম, আয়াত: ১৫১]তিনি আরও বলেন: “দারিদ্রেরভয়ে তোমাদেরসন্তানদেরকেহত্যা করোনা। তাদেরকেএবংতোমাদেরকেআমিই রিযিকদিয়ে থাকি।নিশ্চয়তাদেরকেহত্যা করা মহা অপরাধ।”[সূরাবনী ইসরাইল, আয়াত:৩১]
অধিক জনসংখ্যাআল্লাহর একটি নেয়ামত;এ নেয়ামতের শুকরিয়াআদায় করা ও নিরংকুশভাবেতাঁর ইবাদত করাকর্তব্য। এ কারণেআল্লাহ তাআলা তাঁরনবী শুয়াইব (আঃ)এর কথা উল্লেখকরেন যে, তিনি তাঁরকওমকে আল্লাহরকিছু নেয়ামতেরকথা স্মরণ করিয়েদিতে গিয়ে বলেন:“স্মরণ কর; যখন তোমরাসংখ্যায় কম ছিলে;তিনি তোমাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করলেন।”[সূরাআরাফ, আয়াত: ৮৬]
অধিক জনসংখ্যাউম্মতের মর্যাদাও শত্রুর বিরুদ্ধেবিজয়ী হওয়ার মাধ্যম।তাই তো আল্লাহতাআলা বনী ঈসরাইলদেরসম্পর্কে বলেন:“অতঃপর আমিতোমাদেরজন্যে তাদেরবিরুদ্ধেপালা ঘুরিয়ে দিলাম, তোমাদেরকেধন-সম্পদ ওপুত্রসন্তানদ্বারা সাহায্যকরলাম এবংতোমাদেরকেজনসংখ্যার দিকদিয়ে একটাবিরাটবাহিনীতেপরিণত করলাম।”[সূরাবনী ঈসরাইল, আয়াত:৭]
মিশরের ভবিষ্যতসম্পর্কে এক গবেষণায়ড. মুহাম্মদ সৈয়দগিলাব বলেন: “জনসংখ্যাবৃদ্ধি কখনো বোঝাছিল না এবং আগামীশতাব্দীতেও এটাকেবোঝা গণ্য করাঠিক হবে না। বরংসর্বকালে জনসংখ্যামিশরের অগ্রগতিরপথকে সুগম করেছে।”
ওপর এক গবেষণায়ড. মোস্তফা আল-ফাক্কিআরব বিশ্বে মিশরএকটি প্রভাবশালীদেশ হওয়ার অন্যতমকারণ হিসেবে উল্লেখকরেন- ‘মিশর জনসম্পদেরগুদামঘর হওয়া’।
অর্থনীতিবিশেষজ্ঞ জনাবখোরশেদ আহমাদ বলেন:“ভবিষ্যতে প্রভাবশালীক্ষমতা শুধু সেসবদেশেরই থাকবে যেসবদেশে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার উচ্চপর্যায়ে এবং একইসাথে তারা টেকনিক্যালসাইন্সেও অগ্রসর।তাই পাশ্চাত্যেরজাতিগুলো তাদেরকর্তৃত্ব ও নেতৃত্বধরে রাখার জন্যএশিয়া ও আফ্রিকারদেশগুলোতে জনসংখ্যাহ্রাসকরণ ও বন্ধ্যাকরণআন্দোলন প্রচারকরে যাচ্ছে। একারণে পাশ্চাত্যেরদেশগুলো তাদেরজনসংখ্যা বাড়ানোরজন্য সর্বোচ্চচেষ্টা চালিয়েযাচ্ছে। অপর দিকেতারা এশিয়া ও আফ্রিকারদেশগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণআন্দোলন সর্বত্রছড়িয়ে দিতে সবধরণের প্রচার মাধ্যমেরসর্বোত্তম ব্যবহারকরছে।”। তিনি আরওবলেন: “প্রফেসরঅর্গানস্কি(আমেরিকান বুদ্ধিজীবী)ঠিকই বলেছেন: “ভবিষ্যতেসে সেনাবাহিনীহবে অধিক শক্তিশীলীযার সৈন্য সংখ্যাহবে বেশি।” তিনিআরও বলেন: ইতিহাসেরছাত্রের কাছে এটিঅজানা নয় যে, জনসংখ্যাররয়েছে মৌলিক রাজনৈতিকগুরুত্ব। এ কারণেপ্রত্যেক সভ্যতাও পরাশক্তি তারগঠন ও বিনির্মাণেরযুগে জনসংখ্যাবাড়ানোর উপর অত্যাধিকগুরুত্ব দিয়েছে।তাই তো, উইল ডুরান্ট(Will Durant) অধিক জনসংখ্যাকেসভ্যতার অগ্রসরতারঅন্যতম কারণ হিসেবেগণ্য করেন। অনুরূপভাবেআরনল্ড টয়েনবী(Arnold Toynbee) জনসংখ্যাবৃদ্ধিকে সেসব বুনিয়াদিচ্যালেঞ্জসমূহেরঅন্যতম বলে ঘোষণাকরেছেনযেগুলোর জোরে যেকোন মানব সভ্যতার উন্নতি ওবিস্তৃতি ঘটে।”।
তবে এ বক্তব্যকেযেন ভুলভাবে বুঝানা হয় সেজন্য বলতেহয়: শুধুমাত্রজনসংখ্যা বৃদ্ধিউন্নতি, সমৃদ্ধিও শত্রুর বিরুদ্ধেবিজয়ী হওয়ার গ্যারান্টিদেয় না। বরঞ্চএটি প্রধান কারণ;কিন্তু একমাত্রকারণ নয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির সাথে মজবুতশিক্ষা, সঠিক লালনপালন,সমাজিক ন্যায় ওনিরাপত্তা, দুর্নীতিরবিরুদ্ধে লড়াইথাকতে হবে। বরংসবকিছুর আগে: ঈমানও তাকওয়া থাকতেহবে। আল্লাহ তাআলাবলেন: “আরযদি সে জনপদেরঅধিবাসীরাঈমান আনত ওপরহেযগারীঅবলম্বন করত,তবে আমিতাদের প্রতিআসমানী ও জমিনী নেয়ামতসমূহউম্মুক্ত করেদিতাম। কিন্তুতারা মিথ্যাপ্রতিপন্নকরেছে। ফলে আমিতাদেরকেতাদেরকৃতকর্মের কারণেপাকড়াও করলাম।[সূরা আরাফ;আয়াত: ৯৬]
ইসলামেরশত্রুরা মুসলমানদেরসংখ্যাধিক্য সম্পর্কেজোর গলায় সতর্ককরে আসছে এবং এটাকেতাদের জন্য সবচেয়েবড় হুকমি মনে করছে।
প্রফেসরআরনন সোফার এররচিতChanges in the Geography of the Middle East(১৯৮৪খ্রিঃ)বইতে রয়েছে; যেবইটি ইহুদি রাস্ট্রেপাঠ্যপুস্তকেরঅন্তর্ভুক্ত এবংসে দেশের সংশ্লিষ্টডিপার্টমেন্টগুলোতেএটি ‘রেফারেন্সবই’ হিসেবে গণ্য,গ্রন্থকার মনেকরেন, মিশরের জনসংখ্যারউর্ধ্বগামী হারইসরাইলের আতংকেরকারণ; যেহেতু এরমাধ্যমে শক্তিশালীসেনাবাহিনী গড়েতোলা যেতে পারে।
ডেইলি টেলিগ্রাফপত্রিকা তার ১৯/১/১৯৮৮তারিখের সংখ্যায়‘ভূ-মধ্যসাগরেরঅববাহিকায় জনসংখ্যারটাইম-বোমা’ এ শিরোনামেএকটি প্রবন্ধ ছেপেছে।এ প্রবন্ধে লেখকএ ইস্যুতে আলোচনাকরেছেন যা পাশ্চাত্যেরলোকদের চোখের ঘুমহারাম করে দিয়েছে।সেটা হচ্ছে- ভূ-মধ্যসাগরেরপূর্ব ও দক্ষিণপ্রান্তেঅবস্থিত দেশগুলোতেবড় ধরণের জনসংখ্যাবৃদ্ধি এবং ভূ-মধ্যসাগরেরউত্তরাঞ্চলে অবস্থিতদেশগুলোতে জনসংখ্যাঘাটতি। এ প্রবন্ধেজাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক প্রকল্পেরএকটি প্রতিবেদনথেকে উদ্ধৃতি দেয়াহয় যে, পঞ্চাশ দশকেরদিকে ভূ-মধ্যসাগরীয়অঞ্চলের অধিবাসীদেরদুই তৃতীয়াংশ ছিলইউরোপিয়ান। তারাজিব্রাল্টার প্রণালীথেকে বসফরাস প্রণালীপর্যন্ত বিস্তৃতদেশগুলোতে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল। কিন্তু২০২৫ সাল নাগাদএ চিত্র বিপরীতরূপ ধারণ করবে।অচিরেই ভূ-মধ্যসাগরএকটি ইসলামী সাগরেপরিণত হবে; যদিওপুরোপুরি আরব সাগরেপরিনত না হয়।
কোন সন্দেহ নেই-প্রশ্নে উল্লেখিতউক্তিটি মুসলমানদেরমধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রনও জনসংখ্যা কমানোসংক্রান্ত ইস্যুগুলোকেউৎসাহিত করছে।অনেক শ্লোগানেরঅধীনে এ প্রচারণাগুলোরপ্রতি উৎসাহিতকরা হয়। যেমন- পরিবারনিয়ন্ত্রণ, সমাজনিয়ন্ত্রণ ও পরিবারপরিকল্পনা ইত্যাদি।আমরা বলব: যারাএ বিষয়গুলোর প্রতিউদ্বুদ্ধ করেনতারা ইসলাম ও মুসলমানদেরশত্রুদের পক্ষেকাজ করেন, ইসলামেরশত্রুদের কল্যাণেকাজ করেন; সেটাতারা নিজেরা জানুককিংবা না-জানুক।
শাইখ ইবনে উছাইমীন(রহঃ) বলেন:
জন্ম-নিয়ন্ত্রণকেসমর্থন দেয়া নিঃসন্দেহেএটি মুসলমানদেরশত্রুদের চক্রান্ত।শত্রুরা চায় মুসলমানদেরসংখ্যা না বাড়ুক।কারণ মুসলমানদেরসংখ্যা বাড়লে শত্রুরাসন্ত্রস্ত হয়েপড়ে এবং মুসলমানেরানিজেরা স্বয়ং সম্পূর্ণহয়ে যেতে পারে:নিজেরা চাষাবাদকরবে, ব্যবসা বাণিজ্যকরবে- এর মাধ্যমেঅর্থনৈতিক উন্নতিঘটবে ও আরও নানামুখিকল্যাণ অর্জিতহবে। আর যদি তারাসংখ্যায় অল্প হয়েথাকে তাহলে লাঞ্ছিতহয়ে থাকবে এবংসবকিছুতে অন্যেরমুখাপেক্ষী হয়েথাকবে।[সমাপ্ত]
পরিশেষে, আমাদেরপ্রয়োজন জনসংখ্যাবৃদ্ধি করা এবংএর সাথে সাথে উন্নয়নপরিকল্পনাকে ইসলামীকরণকরা, বিধি-বিধানকেইসলামীকরণ করা,আইন-কানুনকে ইসলামীকরণএবং এর সাথে আধুনিকজ্ঞান-বিজ্ঞানকেকাজে লাগানো।
এ বিষয়ে আরও জানতেদেখুন: আবুল আলামওদূদীর লিখিত‘ইসলামের দৃষ্টিতেজন্মনিয়ন্ত্রণ’(পৃষ্ঠা ১৭৮-১৮৬)ও ‘মাজাল্লাতুলবায়ান’ সংখ্যা১১, ১০৭ ও ১৯১।
আল্লাহই ভাল জানেন।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব