মুমিনরা আখিরাতে তাদের রবকে দেখতে পাবে এমন কিছু কি প্রমাণিত হয়েছে?
মুমিনরা কি জান্নাতে তাদের রবকে দেখবে?
প্রশ্ন: 14525
উত্তরের সংক্ষিপ্তসার
মহান আল্লাহ দুনিয়াতে মুমিন বান্দাদেরকে কিছু অতিরিক্ত নিয়ামত প্রদান করেছেন। তিনি তাদেরকে ইসলাম দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন এবং কুরআনের মাধ্যমে নির্বাচিত করেছেন। জান্নাতে তিনি তাদেরকে এর চেয়েও বড় নিয়ামত প্রদান করবেন। সেটি হলো তিনি তাদেরকে ‘জান্নাতু আদন’ এ স্বীয় সুমহান চেহারার দিকে তাকাতে দেওয়ার মাধ্যমে সম্মানিত করবেন। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “সেদিন কতক চেহারা হবে উজ্জ্বল, তারা তাদের প্রভুর দিকে তাকাবে।”[সূরাতুল কিয়ামা: ২২, ২৩]
Table Of Contents
আল্লাহকে জান্নাতে দেখার ব্যাপারে কুরআন থেকে দলীল:
বান্দাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত অগণিত। আল্লাহ মুমিন বান্দাদেরকে দুনিয়াতে অতিরিক্ত নিয়ামত প্রদান করেছেন। তিনি তাদেরকে ইসলামের নিয়ামত প্রদান করেছেন এবং কুরআনের মাধ্যমে নির্বাচিত করেছেন। জান্নাতে তিনি তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত প্রদান করবেন। আর সেটি হলো ‘জান্নাতু আদন’ এ তাঁর সুমহান চেহারার দিকে দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে সম্মানিত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ* إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
“সেদিক কতক চেহারা হবে উজ্জ্বল, তারা তাদের প্রভুর দিকে তাকাবে।”[সূরাতুল কিয়ামা: ২২, ২৩]
অর্থাৎ মুমিনদের চেহারাগুলো রবের দিকে তাকানোর কারণে সুন্দর, উজ্জ্বল, আনন্দিত থাকবে। যেমনটি হাসান রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: “সেগুলো তাদের রবের দিকে দৃষ্টিপাত করে তাঁর নূর দ্বারা উজ্জ্বল হয়েছে।”
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত: ‘সেদিক কতক চেহারা হবে উজ্জ্বল’ তিনি বলেন: নিয়ামত হিসেবে ‘তাদের প্রভুর দিকে তাকাবে’। তিনি বলেন: ‘তাদের রবের চেহারার দিকে ভালোভাবে দৃষ্টিপাত করবে’। এটা সুন্নাহ ও হাদীসের অনুসারী মুফাস্সিরদের বক্তব্য।
মহান আল্লাহ বলেন:
لَهُمْ مَا يَشَاءُونَ فِيهَا وَلَدَيْنَا مَزِيدٌ
“তারা যা চাইবে তাদের জন্য তাই আছে। আমার কাছে আরো বেশি আছে।”[সূরা ক্বাফ: ৩৫]
এখানে ‘বেশি’ হলো মহান আল্লাহর চেহারায় তাকানো যেমনটি ব্যাখ্যা করেছেন আলী ও আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুমা।
মহান আল্লাহ বলেন:
لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ
“যারা ভালো কাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং বাড়তি পুরস্কার।”[সূরা ইউনুস: ২৬]
কল্যাণ হলো জান্নাত আর বাড়তি পুরস্কার হলো মহান আল্লাহর চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত। এমনটিই ব্যাখ্যা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সহীহ মুসলিমে (২৬৬) বর্ণিত আছে, সুহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: জান্নাতীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বলবেন: ‘তোমরা কি তোমাদের ওপর আরও একটি অনুগ্রহ বাড়াব?’ তারা বলবে: ‘আপনি কি আমাদের চেহারাগুলো আলোকোজ্জ্বল করে দেননি, আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দেননি?” তিনি বলেন: এরপর আল্লাহ তা’আলা পর্দা তুলে নিবেন। আল্লাহর দর্শন লাভের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় আর কিছু তাদেরকে দেয়া হয়নি। তারপর তিনি তিলাওয়াত করলেন এই আয়াত: “যারা ভালো কাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং বাড়তি পুরস্কার।”[সূরা ইউনুস: ২৬]
যেহেতু আপনি জানতে পারলেন যে জান্নাতবাসীদেরকে মহান আল্লাহর চেহারার দিকে তাকানোর চেয়ে প্রিয় আর কিছু দেওয়া হবে না, সেহেতু আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল আল্লাহ যে সমস্ত অপরাধীকে হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন: “কিছুতেই (তাদের কথা সঠিক) নয়, সেদিন তারা তাদের প্রভু থেকে অবশ্যই আড়াল থাকবে।”[সূরা মুতাফ্ফিফীন: ১৫] তাদের জন্য কী ভয়াবহ বঞ্চনা ও বড় মাপের ক্ষতি অপেক্ষা করছে। আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও সুস্থতা কামনা করছি।
শাফেয়ী থেকে বর্ণিত অন্যতম সুন্দর একটি বর্ণনা হলো যা তার ছাত্র রবী ইবনে সুলাইমান তার থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমি মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস আশ-শাফেয়ীর কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলাম তার কাছে একখন্ড মাটির টুকরোতে প্রশ্ন এসেছে: ‘আল্লাহর এই বাণী: “কিছুতেই (তাদের কথা সঠিক) নয়, সেদিন তারা তাদের প্রভু থেকে অবশ্যই আড়াল থাকবে।”[সূরা মুতাফ্ফিফীন: ১৫]-এর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?’ শাফেয়ী বললেন: “যেহেতু তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করেছেন, এর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি সন্তুষ্ট থাকার কারণে তাঁর মিত্ররা তাঁকে দেখতে পাবে।”
মুমিনরা যে তাদের রবকে জান্নাতে দেখতে পাবে এ মর্মে এগুলো কিছু দলীল।
আল্লাহকে জান্নাতে দেখার ব্যাপারে সুন্নাহ থেকে দলীল:
এ ব্যাপারে সুন্নাহর দলীল অগণিত। তন্মধ্যে রয়েছে:
- বুখারী (৬০৮৮) ও মুসলিমে (২৬৭) আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস, কিছু মানুষ বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের রবকে দেখতে পাবো? তিনি বললেন: “পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়?” তারা বলল: না; হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন: “মেঘ না থাকলে কি সূর্য দেখতে তোমাদের কোনো কষ্ট হয়?” তারা বলল: না। তিনি বললেন: “নিশ্চয় তোমরা তাঁকে সেভাবে দেখবে।”… সম্পূর্ণ হাদীস।
বুখারীর এক বর্ণনায় আছে: “তোমরা ভীড়ে পড়ো না অথবা তোমরা অসুবিধায় পড়ো না” (বর্ণনাকারীর সন্দেহ)। অর্থাৎ তোমাদের কাছে কোন অস্পষ্টতা থাকবে না, তাঁর ব্যাপারে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকবে না যে, তোমরা তাঁকে দেখা নিয়ে একে অন্যের সাথে মতভেদ করবে এবং তাঁকে দেখতে তোমাদের কোনো ক্লান্তি বা কষ্ট হবে না। আর আল্লাহই সর্বজ্ঞ।”[সমাপ্ত][শরহু মুসলিম থেকে সমাপ্ত]
- সহীহ বুখারী (৬৮৮৩) ও মুসলিমে (১০০২) জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-বাজালী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বসে ছিলাম। তিনি চৌদ্দ তারিখ রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন: “নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে তেমনি স্পষ্ট দেখতে পাবে, যেমন স্পষ্ট ঐ চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাকে দেখতে তোমরা কোনো ভীড়ের সম্মুখীন হতে হবে না।”
পূর্বোক্ত হাদীসসমূহে যে সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি হলো দর্শনের সাথে দর্শনের সাদৃশ্য। অর্থাৎ আমরা যেমনিভাবে মেঘমুক্ত দিনে সূর্যকে স্পষ্ট দেখতে পাই, দর্শকের সংখ্যা অনেক হলেও সূর্যদর্শনে কেউ কারো প্রতিবন্ধক হয় না এবং যেমনিভাবে আমরা পূর্ণিমার রাতে পূর্ণাঙ্গ চাঁদ স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, দর্শকের সংখ্যা অনেক হলেও এটি দেখার স্পষ্টতাকে প্রভাবিত করে না; ঠিক অনুরূপ স্পষ্টতার সাথে মুমিনরা তাদের রবকে কিয়ামতের দিন দেখতে পাবে। হাদীসগুলোতে দর্শনীয়ের সাথে দর্শনীয়ের (আল্লাহর) সাদৃশ্য দেয়া উদ্দেশ্য নয়; কারণ আল্লাহর সদৃশ কোন কিছু নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।
- বুখারী (৪৫০০) ও মুসলিম (৬৮৯০) আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “(জান্নাতের মাঝে) দুটি বাগান থাকবে। এই দুটির সকল পাত্র এবং এর ভেতরের সকল বস্তু রৌপ্য নির্মিত হবে এবং (জান্নাতে) আরো দুটি উদ্যান থাকবে। এই দুটির সকল পাত্র এবং ভেতরের সকল বস্তু সোনার তৈরী হবে। জান্নাতে আদনে জান্নাতী লোকরা তাদের রবের দর্শন পাবে। এই জান্নাতবাসী ও তাদের রবের দর্শনের মাঝে আল্লাহর চেহারার উপর থাকা তাঁর বড়ত্বের চাদর ছাড়া আর কিছু থাকবে না।”
আল্লাহকে দেখার হাদীস ত্রিশ জনের মত সাহাবী বর্ণনা করেছেন। যে ব্যক্তি এই বর্ণনাগুলো জেনেছেন তিনি নিশ্চয় করে বলবেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি বলেছেন। এরপরও যে দাবি করবে যে আল্লাহকে আখিরাতে দেখা যাবে না, সে কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যা সহকারে পাঠিয়েছেন সেটাকে অস্বীকার করল এবং নিজেকে আল্লাহর তীব্র হুশিয়ারির সম্মুখীন করল, যে হুশিয়ারি দিয়ে আল্লাহ বলেছেন:
كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ
“কিছুতেই (তাদের কথা সঠিক) নয়, সেদিন তারা তাদের প্রভু থেকে অবশ্যই আড়াল থাকবে।”[সূরা মুতাফ্ফিফীন: ১৫] আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে তার চেহারার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ প্রদান করেন। .. আমীন।
সূত্র:
শারহুল আকীদাতিল ওয়াসিত্বিয়্যা (১/২০৯ এবং তৎপরবর্তী অংশ)।
শাইখ হাফিয হাকামীর আ’লামুস সুন্নাহ আল-মানশূরাহ (পৃ. ১৪১)।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ