আমার মা স্নেহশীল নয়, বুঝদার নয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদের সাথে রুক্ষ আচরণ করেন। স্নেহের চোখ দিয়ে তিনি আমাদেরকে দেখেননি। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। একজন নারী হিসেবে তিনি কখনও আমার পাশে দাঁড়াননি। বিয়ের প্রস্তাবক ছেলেদের সাথে ও অন্য মানুষদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হবে একজন নারী হিসেবে তিনি আমাকে সেসব কিছুই শেখাননি। একজন মেয়ের জীবনের অনেক বিষয়েই তিনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। তিনি আমাদের ক্ষেত্রে অনেক অবহেলা করতেন। আল্লাহ্ তাআলা মায়ের অবাধ্যতা ও মার সাথে অসদাচরণের কারণে একজন সন্তানকে যেভাবে বিচারের মুখোমুখি করবেন মাকেও কি অবহেলার কারণে সেভাবে বিচারের মুখোমুখি করবেন? আশা করি জবাব দিবেন।
সন্তান প্রতিপালনে অবহেলা করার ভয়াবহতা
প্রশ্ন: 162787
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
সন্তানদের উপর পিতামাতার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি পিতামাতার উপরও সন্তানদের অধিকার রয়েছে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর; যে আগুনের ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাব ফেরেশ্তাগণ, যারা অমান্য করে না যা আল্লাহ্ আদেশ করেন। তারা যা করতে আদেশপ্রাপ্ত তাই তারা করে।”[সূরা তাহরীম, ৬৬: ৬]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের দায়িত্বশীল; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামী-গৃহের কর্ত্রী; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে…।”[সহিহ বুখারী (৮৯৩) ও সহিহ মুসলিম (১৮২৯)]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: “যে বান্দাকে আল্লাহ কোন জনসমষ্টির দায়িত্বশীল বানান; কিন্তু সে যেদিন মৃত্যুবরণ করে সে দিন এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে খেয়ানত করেছে; আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন।”[সহিহ মুসলিম (১৪২)]
এর থেকে জানা গেল যে, পিতামাতার উপর সন্তানদের কিছু অধিকার রয়েছে; সে সকল অধিকার আদায় করা কর্তব্য। সে অধিকারগুলো অনেক; যেমন-
১। স্বামীর উচিত নিজের জন্য উত্তম স্ত্রী বাছাই করা এবং স্ত্রীর উচিত নিজের জন্য উত্তম স্বামী বাছাই করা। পুরুষ তার জন্য এমন একজন স্ত্রী বাছাই করবেন যে নারী ভবিষ্যতে তার সন্তানদের মা হওয়ার উপযুক্ত। আর নারী এমন একজন পুরুষকে বাছাই করবেন যে পুরুষ তার সন্তানদের পিতা হওয়ার উপযুক্ত।
২। সন্তানের সুন্দর একটি নাম রাখা, তার যত্ম নেয়া এবং তার জন্য খাবার-পানীয়, পোশাকাদি ও বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো সাধ্যানুযায়ী ব্যবস্থা করা; এক্ষেত্রে কৃপণতা বা অপচয় না করা।
৩। পিতামাতার উপর সন্তানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে— উত্তম প্রতিপালন, তাদের চরিত্র ও আচার-আচরণ গঠনে যত্মবান হওয়া, আল্লাহ্ যেভাবে সন্তুষ্ট হন তারা সে ভাবে দ্বীন পালন করছে কিনা সেটা তদারকি করা এবং তাদের দুনিয়াবী প্রয়োজনগুলোরও খোঁজখবর রাখা; যাতে করে তাদের জন্য উপযুক্ত ও সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করা যায়।
সন্তানদের এ অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক পিতামাতাই অবহেলা করেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি নিজেই সন্তানদের মাঝে অবাধ্যতা ও দুর্ব্যবহার টেনে আনেন।
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন:
“যে ব্যক্তি তার সন্তানকে উপকারী শিক্ষা দেয় না, অবহেলায় ছেড়ে দেয় সে তার সন্তানের প্রতি জঘন্যতম অন্যায় করে। অধিকাংশ সন্তান নষ্ট হয় পিতামাতার কারণে, পিতামাতার অবহেলার কারণে এবং সন্তানদেরকে ইসলামের ফরয ও সুন্নত আমলগুলো শিক্ষা না দেয়ার কারণে। এভাবে ছোট বেলায় পিতামাতাই সন্তানদেরকে নষ্ট করে…। এক পর্যায়ে তিনি বলেন: “কত মানুষ নিজেই নিজের সন্তানকে, তার কলিজার টুকরাকে দুনিয়া ও আখিরাতে দুর্ভাগা বানায়; তার প্রতি অবহেলা করা, তাকে শাসন না করা, তাকে ভোগবিলাসে সহযোগিতা করার মাধ্যমে। অথচ সে ব্যক্তি ভাবে যে— সে তাকে খুশি করতেছে; অথচ সে তাকে লাঞ্ছিত করেতেছে। সে ভাবে যে, সে তার প্রতি দয়া করছে; অথচ সে তার প্রতি অন্যায় করছে। এভাবে সে ব্যক্তি সন্তান দিয়ে উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয় এবং সন্তানকেও দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে…।” এক পর্যায়ে তিনি আরও বলেন: “যদি আপনি সন্তান নষ্ট হওয়ার কারণগুলো দেখেন তবে দেখবেন যে, অধিকাংশ সন্তান নষ্ট হওয়ার কারণ পিতামাতা।”[তুহফাতুল মাওদুদ বি আহকামিল মাওলুদ (পৃষ্ঠা- ২২৯, ২৪২) থেকে সমাপ্ত]
তবে, জেনে রাখা উচিত সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার অবহেলার মানে এটা নয় যে, সন্তানও পিতামাতার অধিকারগুলো আদায়ে অবহেলা করবে এবং তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে। বরং সন্তানদের উপর ফরয পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করা। তার প্রতি তাদের দুর্ব্যবহারকে ক্ষমা করে দেওয়া। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “এবং মাতাপিতার প্রতি সদাচারণ” এবং তিনি আরও বলেন: “আর তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে আমার সাথে শির্ক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মেনে নিবে না। তবে, দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে।”[সূরা লোকমান ৩১:১৫]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব