আশা করি আমার এ প্রশ্নটি যখন আপনাদের কাছে পৌঁছবে; তখন আপনারা ভাল ও সুস্থ থাকবেন। আমার প্রশ্ন হল, আমি খেয়াল করেছি যে, কোন অমুসলিম যখন নবুয়তের পর থেকে ইসলামের বয়স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তখন আমরা মুসলমান হিসেবে হিজরতের পরের বছরগুলো উল্লেখ করে জবাব দিই। আমার প্রশ্ন হল: আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পূর্বে নবুয়তের ১৩ টি বছরকে বাদ দিই কেন? আমি জানি, যে বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করেছেন সেটি একটি মহান বছর ছিল। তবে আমরা সকলে জানি যে, নবুয়ত শুরু হয়েছে হিজরতের ১৩ বছর আগে থেকে। তাই আমরা যখন ইসলামের বয়স কত এ প্রশ্নের জবাব দিই তখন আমরা হিজরতের পরের ১৪৩৩ বছর উল্লেখ করি। কেন আমরা ১৩ বছর যোগ করে নবুয়তের পরের ১৪৪৬ বছরের কথা বলি না? ইনশাআল্লাহ্; আপনারা আমাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন।
আমরা ইসলামের বয়স ওহী নাযিলের শুরু থেকে হিসাব না করে হিজরতের শুরু থেকে হিসাব করি কেন?
প্রশ্ন: 176819
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
এতে কোন সন্দেহ নাই যে, হিজরতের পূর্বে মক্কাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বছরগুলো দাওয়াতী কাজে কাটিয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, নির্বোধদের কথা সয়েছেন সে বছরগুলো ইসলামের বয়সের মধ্যে গণ্য। বরং সে বছরগুলো ইসলামের সবচেয়ে মহান বছরগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত; যেহেতু তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অবস্থায় ছিলেন সেটা ছিল তাঁর রবের উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল, তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণ ও তাঁর পথে নির্যাতন সহ্য করণের অবস্থা। এ বিষয়টিতে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সন্দেহ করে না এবং আদৌ কেউ এটি অস্বীকার করে না; এমনকি সে ব্যক্তি মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম। কিন্তু মানুষ যে কারণে ক্যালেন্ডারে এবং যে কোন ঘটনার বছর উল্লেখ করার ক্ষেত্রে হিজরী সনের উপর নির্ভর করে এবং যে সনটি মানুষের কথাবার্তায় অধিক ব্যবহৃত হয়— এর কারণ হল উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর যামানায় সাহাবায়ে কেরাম যখন সন প্রবর্তন করতে চাইলেন তখন তারা হিজরতকে ভিত্তি করে সন প্রবর্তন করার ব্যাপারে একমত হন। কেননা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রকৃত তারিখ তো সেটাই— নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদীনাতে অবতীর্ণ হওয়া, লোকেরা তাঁর পাশে একত্রিত হওয়া, তাঁকে সাহায্য করা ও হিজরতের মাধ্যমে আরও যা কিছু ঘটেছে সে সব কারণে। এগুলোর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখাগুলো ফুটে উঠা শুরু হয়। ভৌগোলিক, সামাজিক, সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠে। এর আগে মুসলমানদের কোন রাষ্ট্র ছিল না। তাদের সার্বিক কোন নিয়ম ছিল না।
সাহাবায়ে কেরাম হিজরী ১৬ সালে, কারো কারো মতে, ১৭ সালে, কারো কারো মতে, ১৮ সালে উমর (রাঃ)-এর শাসনামলে হিজরতের বছরকে ইসলামী সনের সূচনা হিসেবে নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হন। এর পটভূমি হল আমীরুল মুমিনীন উমর (রাঃ) এর কাছে একটি দলিল পেশ করা হয়। উক্ত দলিলে এক ব্যক্তির অপর ব্যক্তির পাওনা হিসেবে লেখা ছিল: 'শাবান মাসে তার উপর (পরিশোধ করা) অবধারিত হবে'।
তখন উমর (রাঃ) বললেন: কোন শাবান? আমরা এখন যে বছরে আছি সে বছরের শাবান? নাকি গত বছরের শাবান? নাকি আগামী বছরের শাবান? এরপর তিনি সাহাবীদেরকে একত্রিত করে তাদের সাথে সন প্রবর্তন করার ব্যাপারে পরামর্শ করেন; যাতে করে তারা ঋণ ও অন্যান্য বিষয়ের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। তখন এক ব্যক্তি বললেন: পারস্যবাসীর সনের মত সন প্রবর্তন করুন। কিন্তু উমর (রাঃ) সেটা অপছন্দ করলেন। অপর এক ব্যক্তি বললেন: রোমানদের সনের মত সন প্রবর্তন করুন; তিনি সেটাও অপছন্দ করলেন। অন্য ব্যক্তিরা বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন থেকে সন নির্ধারণ করুন। কেউ কেউ বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তপ্রাপ্তি থেকে সন নির্ধারণ করুন। কেউ কেউ বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের দিন থেকে সন নির্ধারণ করুন। কেউ কেউ বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর দিন থেকে সন নির্ধারণ করুন।
উমর (রাঃ) হিজরতের বছর থেকে সন নির্ধারণের দিকে ঝুঁকলেন; যেহেতু হিজরতের তারিখটি বেশি মশহুর। এতে সাহাবায়ে কেরামও একমত হলেন। অর্থাৎ তারা হিজরতের বছর থেকে ইসলামী সনের সূচনা ধরার ব্যাপারে একমত হলেন। এ সনের প্রথম মাস হিসেবে 'মুহররম' মাসকে নির্ধারণ করেন মর্মে তাদের থেকে প্রসিদ্ধ আছে। এটাই জমহুর আলেমের অভিমত; যাতে করে নিয়মে কোন গোলযোগ না ঘটে।[দেখুন: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ (২৫১-২৫৩)]
ইমাম বুখারী তাঁর সহিহ গ্রন্থে (৩৯৩৪) 'সাহল বিন সা'দ' থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: তারা (সাহাবীরা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের বছর থেকেও গণনা করেননি, মৃত্যুসাল থেকেও গণনা করেননি; তারা গণণা করেছেন তাঁর মদীনায় আগমনের বছর থেকে।
হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন: কোন কোন আলেম হিজরতের বছর থেকে সন গণনা শুরু করার সাযুজ্যতা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন: যে ঘটনাগুলো তাঁর জীবনে ঘটেছে এবং যেগুলোকে সন গণনার শুরু ধরা যেতে পারে এমন ঘটনা চারটি: তাঁর জন্ম, তাঁর নবুয়তপ্রাপ্তি, তাঁর হিজরত ও তাঁর মৃত্যু। তাদের নিকট (সাহাবীদের নিকট) হিজরত থেকে সন গণনার শুরু ধরা প্রাধান্য লাভ করেছে। কেননা জন্মবর্ষ ও নবুয়তপ্রাপ্তির বর্ষ কোনটি সেটা বিতর্কমুক্ত নয়। মৃত্যুবর্ষকে শুরু ধরেননি যেহেতু সেটার স্মরণ শোকাবহ। তাই আর বাকী রইল হিজরতের বর্ষ। তারা রবিউল আউয়াল মাসকে বাদ দিয়ে মুহররম মাসকে শুরু ধরেছেন যেহেতু হিজরত করার পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত মুহররম মাস থেকে শুরু হয়। যেহেতু বাইআত সংঘটিত হয়েছে যিলহজ্জ মাসে। বাইআতই ছিল হিজরতের প্রারম্ভিকা। বাইআতের পর প্রথম চাঁদ ছিল মুহররম মাসের চাঁদ, হিজরতের দৃঢ় সিদ্ধান্ত হয়েছে মুহররমের চাঁদে। তাই মুহররমকে শুরু ধরা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। মুহররম থেকে বছরের শুরু ধরার ব্যাপারে আমি যত বক্তব্য পেয়েছি তার মধ্যে এটি সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত।
ইমাম হাকেম সাঈদ বিন মুসায়্যিব থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: "উমর (রাঃ) লোকদেরকে সমবেত করে কোনদিন থেকে সন গণনার শুরু ধরা হবে সে সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। তখন আলী (রাঃ) বললেন: যেই দিন রাসূলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করেছেন এবং শির্কের এলাকা ত্যাগ করে এসেছেন সেই দিন থেকে। তখন উমর (রাঃ) সেটাই করলেন…।"[সংক্ষেপে সমাপ্ত]
তাই যিনি ইসলামের বয়সকে হিজরত থেকে গণনা করেন তিনি সন ও ক্যালেন্ডারকে উদ্দেশ্য করে থাকেন এবং দিন ও ঘটনা জানার ক্ষেত্রে এবং মানুষের আকদ-চুক্তি ও যাত্রা ইত্যাদি জানার ক্ষেত্রে মানুষ যে একক নিয়মের উপর একমত হয়েছে সেটাকে বুঝিয়ে থাকেন। মানুষ এ নিয়মের উপর উমর (রাঃ) এর খিলাফতকাল থেকে আমাদের আজকের সময় পর্যন্ত একমত। যিনি এই সনের ভিত্তিতে ইসলামের বয়স নির্ধারণ করেন তিনি বুঝাতে চান- ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বয়স। ইসলাম রাষ্ট্র হিজরতের মাধ্যমেই শুরু হয়েছে।
পক্ষান্তরে, ইসলামের শুরু এবং ইসলাম সম্পর্কে মানুষের জানাজানির শুরু এর আগে থেকে; এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়োজন নাই। বরং ব্যাপক অর্থ ইসলাম হচ্ছে ঐ ধর্ম বান্দাদের জন্য যে ধর্মই হচ্ছে আল্লাহ্র মনোনীত এবং যে ধর্ম দিয়ে আল্লাহ্তাঁর নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। এখানে সে অর্থ উদ্দেশ্য নয়।
আমরা মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যিনি মনে করেন যে, ইসলামের প্রকৃত সূচনা হিজরত থেকে এবং দাওয়াতের যে বছরগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গে যারা মক্কাতে কাটিয়েছেন সে বছরগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়। এমন কথা কেউ বলেনি।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব