প্রশ্ন: ঈদের নামাযের তাকবীর কি ৬ টি; নাকি ১২ টি? কারণ এখানে এ মাসয়ালা নিয়ে হানাফী মাযহাবের অনুসারী ও সালাফীদের মধ্যে তীব্র বিরোধ হচ্ছে। সালাফীরা বলেন: ‘তারা কিছুতেই হানাফীদের পিছনে নামায পড়বে না; যদি তারা দুই রাকাত নামায ১২ তাকবীর দিয়ে পড়তে প্রস্তুত না থাকে’। অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে হানাফীরা এটি করতে প্রস্তুত নয়। এ কারণে একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঈদের নামায দুইবার পড়া হয়। এ ব্যাপারে শরিয়তের হুকুম কি? এ ক্ষেত্রে কোন মধ্যমপন্থী সমাধানে পৌঁছা কি সম্ভব; যাতে করে এক ঈদের নামায হানাফী মাযহাব অনুযায়ী পড়া হবে এবং দ্বিতীয় ঈদের নামায সালাফী মাযহাব অনুযায়ী পড়া হবে?
ঈদের নামাযে তাকবীরের সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্যের কারণে তারা সে ইমামের পিছনে নামায পড়ে না
প্রশ্ন: 224032
উত্তরের সংক্ষিপ্তসার
সারকথা হল: দুই ঈদের নামাযে তাকবীরের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ করে মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা ও আলাদা নামায কায়েম করা জায়েয নয়। কারণ ঈদের নামায দুইবার পড়া এবং প্রত্যেক দল নিজেদের মতানুযায়ী আলাদাভাবে নামায আদায় করা গর্হিত বিদআত। এটি মুসলমানদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে— এটা কারো কাছে অজ্ঞাত নয়। শরিয়ত এ ধরণের গর্হিত কাজের অনুমোদন দিতে পারে না কিংবা সুন্নাহ হতে এ ধরণের কোন নির্দেশনা আসতে পারে না। তাই এ ধরণের কোন কথা বলা জায়েয হবে না যে, আমরা সালাফী পদ্ধতিতে একবার নামায আদায় করব এবং আরেকবার হানাফি পদ্ধতিতে নামায আদায় করা হবে। বরং সকলেই একই পদ্ধতিতে নামায আদায় করতে আদিষ্ট। সেটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবর্গের পদ্ধতি এবং যে পদ্ধতির উপর আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ি, আহমাদ মুসলিম উম্মাহর প্রমুখ ইমামগণ অতিবাহিত হয়েছেন। আর যে বিষয়গুলোতে সাহাবায়ে কেরাম ও ওলামায়ে কেরাম মতভেদ করেছেন সেসব ইখতিলাফের ক্ষেত্রে আমাদের হৃদয়গুলো প্রশস্ত থাকা উচিত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন মুসলমানদেরকে সত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ করে দেন এবং তাদের হৃদয়গুলো একীভূত করে দিন। আল্লাহই ভাল জানেন।
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
এটিএকটিইজতাহিদীমাসয়ালা। এনিয়ে সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীও পরবর্তী ইমামদেরমধ্যে মতানৈক্যআছে এবং এমাসয়ালায়১০টিরও অধিক মতামতরয়েছে।
‘আল-মাওসুআআল-ফিকহিয়্যা’(১৩/২০৯) তেএসেছে-
মালেকীও হাম্বলিমাযহাবেরআলেমগণ বলেন:ঈদের নামাযেরপ্রথম রাকাতেতাকবীরসংখ্যা ৬টি এবংদ্বিতীয়রাকাতে ৫টি।এটি মদিনারসাত ফকীহ, উমরইবনে আব্দুলআযিয, যুহরী ওমুযানি থেকেবর্ণিত আছে।
বুঝাযাচ্ছে- প্রথমরাকাতেতাকবীরেতাহরীমাকেতারা সপ্তমতাকবীরহিসেবে গণ্যকরেন এবং দ্বিতীয়রাকাতেরজন্যদাঁড়ানোরতাকবীরকেতারা বর্ণিতপাঁচটিতাকবীরের অতিরিক্ততাকবীরহিসেবে গণ্যকরেন।
আরহানাফীমাযহাবেরঅভিমত ও একবর্ণনা মতেইমাম আহমাদের মতহচ্ছে: দুইঈদের নামাযেঅতিরিক্ত ৬তাকবীর দিতেহবে। প্রথমরাকাতে ৩তাকবীর,দ্বিতীয়রাকাতে ৩ তাকবীর।এটি ইবনেমাসউদ (রাঃ),আবু মুসাআশআরী (রাঃ),হুযাইফাতুলইয়ামান(রাঃ), উকবাবিন আমের(রাঃ), ইবনেযুবায়ের(রাঃ), আবু মাসউদআল-বদরী(রাঃ), হাসানবসরী (রহঃ),মুহাম্মদ বিনসিরিন (রহঃ),ছাওরী (রহঃ),কুফার আলেমগণও এক বর্ণনামতে ইবনেআব্বাস (রাঃ)এর অভিমত।
শাফেয়িমাযহাবেরআলেমগণ বলেন:প্রথম রাকাতে অতিরিক্ততাকবীর ৭টিএবং দ্বিতীয়রাকাতে ৫টি।
আইনী(রহঃ)অতিরিক্ততাকবীরেরসংখ্যারব্যাপারে ১৯টি উক্তিউল্লেখকরেছেন…।[সমাপ্ত]
শাওকানী(রহঃ) বলেন: দুইরাকাত ঈদেরনামাযের তাকবীরেরব্যাপারে ওতাকবীর দেয়ারস্থানের ব্যাপারেআলেমগণের ১০অভিমত রয়েছে।এক. প্রথম রাকাতেক্বিরাতেরআগে ৭ তাকবীরদিবে এবং দ্বিতীয়রাকাতেক্বিরাতেরআগে ৫ তাকবীরদিবে। ইরাকীবলেন: এটিঅধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ীও ইমামদেরঅভিমত। দুই. প্রথমরাকাতেতাকবীরেতাহরীমা ৭তাকবীরেরমধ্যে গণ্য—এটি ইমামমালেক, আহমাদও মুযানিরঅভিমত।
তিন.প্রথম রাকাতে৭ তাকবীর ওদ্বিতীয়রাকাতে ৭তাকবীর। আনাসবিন মালেক(রাঃ), মুগিরাবিন শুবা (রাঃ),ইবনে আব্বাস(রাঃ), সাঈদ ইবনুলমুসায়্যিব(রহঃ) ও নাখায়ী(রহঃ) থেকে এমতটি বর্ণিতআছে।
চার.প্রথম রাকাতেতাকবীরেতাহরীমার পরক্বিরাতেরআগে ৩ তাকবীর এবংদ্বিতীয়রাকাতেক্বিরাতের পর৩ তাকবীর। এটিএকদল সাহাবী,ইবনে মাসউদ(রাঃ), আবু মুসা(রাঃ) ও আবুমাসউদ আনসারী(রাঃ) থেকেবর্ণিত আছে এবংএটি ইমামছাওরী (রহঃ)ও ইমাম আবুহানিফা (রহঃ)এর অভিমত…[নাইলুলআওতার (৩/৩৫৫)থেকে সমাপ্ত]
এবিষয়েসর্বাধিকবিশুদ্ধহচ্ছে- আয়েশা(রাঃ) এর হাদিস: “রাসূলুল্লাল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুলফিতর ও ঈদুলআযহার নামাযেপ্রথম রাকাতে৭ তাকবীর ওদ্বিতীয় রাকাতে৫ তাকবীরদিতেন।”[সুনানেআবু দাউদ(১১৪৯), আলবানীসহিহ সুনানে আবুদাউদ গ্রন্থেএ হাদিসটিকেসহিহআখ্যায়িত করেছেনএবং এটিঅধিকাংশআলেমের অভিমত]
ইবনেআব্দুল বার(রহঃ) বলেন:
দুইঈদের নামাযেরব্যাপারে নবীসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে‘হাসান’ সনদে বহুরেওয়ায়েতরয়েছে যে,তিনি প্রথমরাকাতে ৭তাকবীর ওদ্বিতীয়রাকাতে ৫ তাকবীর দিয়েছেন। কিন্তু,সাহাবায়েকেরাম এ নিয়েতীব্রমতানৈক্যকরেছেন।অনুরূপভাবেতাবেয়ীগণ এনিয়ে মতভেদকরেছেন।[তামহীদ(১৬/৩৭-৩৯) থেকেসমাপ্ত]
আরওজানতে দেখুন: 36491 নংপ্রশ্নোত্তর।
দুই:
এ ধরণেরমাসয়ালাতেমতবিরোধ করার যথাযথ সুযোগরয়েছে। এক্ষেত্রে মতানৈক্যকারীকেনিন্দা করাযাবে না।কিভাবেনিন্দা করাহবে, যাসাহাবায়েকেরাম থেকেবর্ণিত আছে।সাহাবায়েকেরাম হচ্ছেন—ইজতিহাদেরউপযুক্ত ইমামও সুন্নাহরঅনুসারী ওঅনুসৃত ইমাম।
একারণেইমাম আহমাদেরঅভিমত হচ্ছে-ঈদের নামাযেরঅতিরিক্ততাকবীরের ব্যাপারেসাহাবায়েকেরাম থেকে যেসব অভিমত বর্ণিতআছে এরসবগুলোর উপরআমল করাজায়েয। তিনি বলেন:“রাসুলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লামেরসাহাবীগণতাকবীরেরব্যাপারেমতভেদ করেছেন;এর প্রত্যেকটিজায়েয।”[আল-ফুরু(৩/২০১) থেকেসমাপ্ত]
শাইখমুহাম্মদ বিনউছাইমীন (রহঃ)প্রথম রাকাতে৭ তাকবীর ওদ্বিতীয়রাকাতে ৫তাকবীর দেয়ারকথা উল্লেখকরে বলেন: “যদিকেউ এরব্যতিক্রমকিছু করেযেমন- প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় রাকাতে৫ টি করেতাকবীর দেয়কিংবা উভয় রাকাতে৭ টি করেতাকবীর দেয়যেভাবেসাহাবীদেরথেকে বর্ণিতআছে তাহলেইমাম আহমাদ বলেন:নবীসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরাতাকবীরেরব্যাপারেমতভেদ করেছেন এবংপ্রত্যেকটিজায়েয।অর্থাৎ ইমামআহমাদ মনেকরেন,এক্ষেত্রেবিষয়টিপ্রশস্ত। যদিকেউ উল্লেখিতপদ্ধতিরবিপরীত কিছুকরে যেভাবেসাহাবায়েকেরাম থেকেবর্ণিত আছেতাহলে এতে কোনঅসুবিধা নেই।ইমাম আহমাদেরমাযহাব হচ্ছে-যদি সলফে সালেহীনগণকোন মাসয়ালায়মতানৈক্যকরেন এবং সংশ্লিষ্টমাসয়ালায়অকাট্য কোনদলিল না থাকে তাহলেএক্ষেত্রেসবকটিঅভিমতের উপরআমল করা জায়েয।কারণ তিনিসাহাবীদেরকথাকেমর্যাদা দিতেনএবং মূল্যায়নকরতেন। তিনিবলেন: যদি কোনঅকাট্য দলিলনা থাকে;যে দলিলসাহাবীদেরকোন উক্তিগ্রহণে প্রতিবন্ধকহয় না তাহলেসেক্ষেত্রেবিষয়টিপ্রশস্ত।নিঃসন্দেহেইমাম যে পথঅনুসরণকরেছেন সেটাউম্মতেরঐক্যেরসবচেয়ে উত্তমপন্থা। কারণকোন কোনব্যক্তি যেসবমাসয়ালায়ভিন্নমতপ্রকাশ করার ওইজতিহাদ করারসুযোগ আছেসেসব মতকেউম্মতেরঅনৈক্য ওবিভক্তির মাধ্যমহিসেবে গ্রহণকরে। এমনকিকেউ কেউ তার মুসলিমভাইকে গোমরাহবলতেও দ্বিধাকরে না অথচ হতেপারে সে নিজেইগোমরাহ। এযামানায় চরমআকার ধারণ করাসংকটগুলোরমধ্যে এটিঅন্যতম। যদিওএ যামানাতেযুব সমাজেরজাগরণআশাব্যঞ্জক। এধরণের সংকট এজাগরণকে নষ্টকরে দিতেপারে এবংবিচ্ছিন্নতারকারণে উম্মাহআবার ঘুমিয়ে পড়তে পারে।কারণ কেউ যদিতার মুসলিমভাই এর সাথেকোন ইজতিহাদীমাসয়ালায়মতভেদ করে; যেমাসয়ালাতেকোন অকাট্যদলিল নেই; সে ব্যক্তি ঐভাই থেকে দূরেসরে যায়, তাকেগালিগালাজকরে, তার সমালোচনাকরে— এটিমুসিবত; এতেসবচেয়ে খুশিহয় এ জাগরণেরশত্রুরা।
যদিকোন মাসয়ালাইজতিহাদেরউপযুক্ত হয়তাহলেসেক্ষেত্রেএকে অপরেরওজর গ্রহণ করাউচিত। তবে,মুসলমানভাইদেরপরস্পরেরমধ্যে শান্তিপূর্ণআলোচনাতেকোন বাধা নেই।আমি বলব:আল্লাহ তাআলাইমাম আহমাদকেউত্তমপ্রতিদান দিন;যিনি এ সুন্দরপথটি গ্রহণ করেছেন:যখন সলফেসালেহীন কোনমাসয়ালায়মতানৈক্য করেএবং এক্ষেত্রে কোনঅকাট্য দলিলনা থাকেসেক্ষেত্রেবিষয়টিপ্রশস্ত এবংসবগুলো অভিমতেরউপর আমল করাজায়েয।[আল-শারহুলমুমতি (৫/১৩৫-১৩৮)]
উপরোক্তআলোচনাথেকে জানাযায় যে,সাহাবায়েকেরাম থেকে যেঅভিমত বর্ণিতআছে সেঅভিমতের উপরআমল করলে এতেকোন অসুবিধানেই। যদিওউত্তম হচ্ছে—প্রথম রাকাতে৭ তাকবীর দেয়াএবং দ্বিতীয়রাকাতে ৫তাকবীর।
তিন:
অন্তরগুলোকেএক সূতায়বেঁধে রাখা ওঐক্যবদ্ধ থাকাকর্তব্য।ইসলামের এটিএকটি মৌলিকনীতি। একটিসুন্নতেরকারণে এমূলনীতিকেধ্বংস করাজায়েয হবে না।কেউ এ সুন্নতপালন না করলেওকোন অসুবিধানেই।হ্যাঁ,আলোচনা,পর্যালোচনা ওসংলাপ করতেকোন অসুবিধানেই যাতে করেসুন্নাহরঅধিকতর নিকটবর্তীউক্তিটিগ্রহণ করাযায়। কিন্তু,যদি দুইপক্ষের মধ্যে মতৈক্যনা ঘটে এবংপ্রত্যেক দলমনে করে,তারাই হকেরকাছাকাছি এবংতারাসাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীও ইমামদেরঅনুসরণ করছেসেক্ষেত্রেকর্তব্যহচ্ছে শহরেরসকল মুসলমানএকজন ইমামেরইমামতিকেমেনে নেয়া এবংবিচ্ছিন্ন নাহওয়া। কারণতাদের এবিচ্ছিন্নতাশয়তানের পক্ষথেকে এবং এতেতাদের শত্রুতাখুশি হয়।
ইতিপূর্বে12585 নংপ্রশ্নোত্তরেউল্লেখ করাহয়েছে যে, যদিইমাম নামাযেরমধ্যে এমন কোনআমল করে যাআমল করাটামোক্তাদিশরিয়ত সম্মতমনে করে না;সেক্ষেত্রেওমোক্তাদিরউপর ফরযইমামের অনুসরণকরা; যেহেতুমাসয়ালাটিইজতিহাদী। এইব্যক্তিরাযদিআব্দুল্লাহইবনে মাসউদ(রাঃ) কিংবাআবু মুসাআশআরী (রাঃ) কিংবাআবু মাসউদআল-বদরী(রাঃ) এর মতমর্যাদাবানসাহাবায়েকেরামেরপিছনে নামাযআদায় করতেনতখন তারা কিকরতেন! এসাহাবীরাপ্রথম রাকাতে৩ তাকবীর ওদ্বিতীয়রাকাতে ৩ তাকবীরদিয়ে নামাযপড়তেন। তারাকি এ মহানইমামদেরপিছনে নামাযপড়া বর্জনকরতেন? যাঁরাউম্মতের ইমাম,সবচেয়েজ্ঞানী ওসর্বাধিক পবিত্রআত্মারঅধিকারী?!
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ