আমি নিজের হজ্জ আদায় করেছি। হজ্জ করার কয়েক মাসের মধ্যে আমি হজ্জ কবুল হওয়ার কোন আলামত দেখিনি; যেমন- নেকীর কাজে এগিয়ে আসা। বরং আমি অনেক অনেক পাপ কাজে লিপ্ত হয়েছি। পরের বছর আমি আমার মৃত মা-এর পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি এক শাইখকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি আমাকে মা-র পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করার এবং বেশি বেশি ইস্তিগফার ও কায়মনোবাক্যে দোয়া করার ফতোয়া দিয়েছেন। আমি এক হজ্জ কাফেলার সাথে আমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করেছি। বিদায়ী তাওয়াফকালে প্রচণ্ড ভীড় ছিল। ভীড়ের মধ্যে আমি এক চক্কর শেষ করে আরেক চক্কর এর সামান্য কিছু আদায় করে ছাদে উঠেছি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে ঠিক কোন স্থানে আমি তাওয়াফ স্থগিত করেছিলাম তা জানতে পারিনি। কিন্তু, ছাদে তাওয়াফ শুরু করার আগে আমি চেষ্টা করেছি যাতে করে আমি নীচে যে স্থানে তাওয়াফ স্থগিত করেছি ঠিক সে স্থান থেকে তাওয়াফটা শুরু হয়। এভাবে আমি তাওয়াফ শেষ করেছি।
পাপীর উপর পাপের কুফল
প্রশ্ন: 23425
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
এক: প্রশ্নকারী ভাই, আমরা আপনাকে ছগিরা-কবিরা সকল গুনাহ্ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিচ্ছি। পাপ থেকে আপনি সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করুন। কারণ পাপীর ওপর পাপের খারাপ প্রভাব থাকবেই। ইবনুল কাইয়্যেম এর বাণী থেকে পাপের কিছু কুফল আপনার সমীপে পেশ করছি:
১। ইল্ম অর্জন থেকে বঞ্ছিত হওয়া। কারণ ইল্ম হচ্ছে– নূর; যা আল্লাহ্ অন্তরে ঢেলে দেন। পাপ এ নূরকে নিভিয়ে দেয়। ইমাম শাফেয়ি যখন ইমাম মালেকের সামনে বসে পড়া শুরু করলেন তখন ইমাম মালেক তার বিচক্ষণতা, প্রখর-মেধা ও পরিপূর্ণ-বোধশক্তি দেখে অভিভূত হয়ে বললেন: “আমি দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ্ তোমার অন্তরে নূর ঢেলে দিয়েছেন। সুতরাং এ নূরকে গুনাহ্ দিয়ে নিভিয়ে ফেলো না”।
২। রিযিক থেকে বঞ্ছিত হওয়া। মুসনাদে আহমাদে সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় মানুষ পাপ করার কারণে রিযিক থেকে বঞ্ছিত হয়”[সুনানে ইবনে মাজাহ (৪০২২), আলবানী সহিহ ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]
৩। পাপী ও তার প্রতিপালকের মাঝে এবং পাপী ও মানুষের মাঝে দূরত্ব তৈরী হয়। জনৈক পূর্বসুরি আলেম বলেন: “আমি আল্লাহ্র অবাধ্য হলে সেটার কুফল নিশ্চিতভাবে আমার বাহন ও আমার স্ত্রীর আচরণে দেখতে পাই”।
৪। পাপী ব্যক্তির যে কোন কাজ কঠিন হয়ে যায়: সে যে কাজে হাত দেয় তার মুখের উপর সে পথ রুদ্ধ হয়ে যায় কিংবা কঠিন হয়ে যায়। যেভাবে মুত্তাকী ব্যক্তির জন্য যে কোন কাজ সহজ হয়ে যায়।
৫। পাপী ব্যক্তি অন্তরে অন্ধকার ভাব অনুভব করে যেভাবে সে রাতের অন্ধকারকে অনুভব করে। এভাবে তার অন্তরের উপর পাপের অন্ধত্ব দৃষ্টিশক্তির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অন্ধত্বে পরিণত হয়। কারণ আল্লাহ্র আনুগত্য হচ্ছে– আলো। আর পাপ হচ্ছে– আধাঁর। যখনই অন্ধকার প্রগাঢ় হয়ে উঠে তখনি তার হত-বুদ্ধিতা বেড়ে যায়; এমনকি সে নিজের অজান্তে বিদাত, পথভ্রষ্টতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেভাবে অন্ধ ব্যক্তি রাতের আধাঁরে একাকী হাঁটলেও টের পায় না। এই অন্ধত্ব শক্তিশালী হতে হতে এক পর্যায়ে চোখে দেখা দেয়, এরপর চেহারাতেও দেখা দেয়। শেষমেষ এমন কালো হয়ে যায় যে, যে কেউ সেটা দেখতে পায়। আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন: “নেক কাজ চেহারায় উজ্বলতা, অন্তরে আলো, রিযিকে প্রশস্ততা, শারীরিক শক্তি ও মানুষের মনে ভালোবাসা আনয়ন করে। আর বদকাজ চেহারায় কালিমা, অন্তরে আঁধার, শারীরিক দুর্বলতা, রিযিকের ঘাটতি ও মানুষের মনে ঘৃণা আনয়ন করে”।
৬। নেক আমল করা থেকে বঞ্ছিত হওয়া। যদি পাপের অন্য কোন শাস্তি নাও থাকত, তবে এটাই পাপের শাস্তি যে এটি একটি পূণ্যকে প্রতিহত করে; পাপের স্থলে যে পূণ্যটি সম্পাদিত হতে পারত এবং অপর একটি পূণ্যের রাস্তা কর্তন করে দেয়। এভাবে পাপের কারণে পাপী লোকের পূণ্য অর্জনের তৃতীয় রাস্তা, চতুর্থ রাস্তা একের পর এক অবরূদ্ধ হতেই থাকে। ফলে পাপী লোক পাপের কারণে অনেক নেকী থেকে বঞ্ছিত হয়। যে নেকীর প্রত্যেকটি দুনিয়া ও দুনিয়ার উপর যা কিছু আছে সবকিছু থেকে উত্তম। এর উদাহরণ হচ্ছে সে ব্যক্তির মত যে ব্যক্তি একবার খাবার খেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে, যে অসুস্থতার কারণে সে ব্যক্তি উক্ত খাবারের চেয়ে আরো ভাল ভাল অনেক খাবার থেকে বঞ্ছিত হয়েছে। আল্লাহ্ই সহায়।
৭। পাপে পাপ টেনে আনে, পাপে পাপ জন্ম দেয়; এক পর্যায়ে পাপ পরিহার করা ও এর থেকে বেরিয়ে আসা বান্দার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
৮। পাপ মনের ইচ্ছাকে দুর্বল করে দেয়। মনের ইচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়লে পাপের ইচ্ছা শক্তিশালী হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে তওবা করার সংকল্প দুর্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তওবা করার ইচ্ছা অন্তর থেকে নির্মূল হয়ে যায়।… এরপর কেউ হয়তো মুখে মুখে অনেক ইস্তিগফার ও মিথ্যা তওবা করে; অথচ তার অন্তর পাপ সম্পাদনে দৃঢ়চিত্ত, অনঢ় ও সংকল্পবদ্ধ; যখন সুযোগ হয়। এটি মহামারী ও ধ্বংসাত্মক বিমার।
৯। পাপীর অন্তর থেকে পাপের প্রতি ঘৃণাবোধ চলে যায়; এক পর্যায়ে পাপটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন মানুষ তাকে পাপের মধ্যে দেখছে বা তার সমালোচনা করছে এগুলোতে তার সংকোচ হয় না।
পাপীদের কাছে এটি বেপরোয়ার চূড়ান্ত সীমা ও পরিপূর্ণ মজা। এ পর্যায়ে এসে তারা পাপে লিপ্ত হয়ে গর্ববোধ করে এবং যারা তার পাপে লিপ্ত হওয়ার কথা শুনেনি তাদেরকেও সে নিজের পাপের কথা অবহিত করে। সে মানুষকে ডেকে বলে: এই অমুক, আমি এই এই করেছি। এ শ্রেণীর লোকদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমা করা হয় না, তাদের তওবার দরজা রুদ্ধ ও বন্ধ করে রাখা হয়। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমার সকল উম্মত ক্ষমার্হ; শুধু প্রকাশ্যে-পাপকারীরা ছাড়া। প্রকাশ্য পাপের মধ্যে এটাও পড়ে যে, আল্লাহ্ বান্দার গুনাহকে ঢেকে রেখেছেন। কিন্তু, বান্দা সকালে জেগে উঠে নিজেই নিজেকে উন্মুক্ত করে দিল। বলে: ওহে অমুক! আমি অমুক দিন অমুক অমুক কাজ করেছি। এভাবে সে নিজে নিজেকে বেইজ্জত করে। অথচ গোটা রাত আল্লাহ্ তাকে ঢেকে রেখেছিলেন।”[সহিহ বুখারী (৫৯৪৯) ও সহিহ মুসলিম (২৭৪৪)]
১০। পাপ যখন অনেক বেড়ে যায় তখন পাপীর অন্তরের উপর মোহর বা সিল মেরে দেওয়া হয়। যার ফলে সে গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। তাই জনৈক পূর্বসুরি আলেম আল্লাহ্র বাণী: “কখনও নয়; বরং তারা যা করত সেটাই তাদের অন্তরে রা-ন (পাপের আবরণ) ফেলেছে” সম্পর্কে বলেন: তা হচ্ছে– পাপের পর পাপ করা।
এ কথার বিশ্লেষণ এভাবে– পাপের কারণে অন্তরে মরিচা পড়ে। পাপ যখন বেড়ে যায় তখন মরিচা জটিল আকার ধারণ করে এক পর্যায়ে সেটা রা-ন (পাপের আবরণে) পরিণত হয়। তারপরও মরিচা বাড়তে বাড়তে ‘সিলগালা’ ও তালাবদ্ধ’ অবস্থায় পরিণত হয়। তখন অন্তরটা একটা আবরণ ও আচ্ছাদনের ভেতরে থাকে। যদি তার এ অবস্থা হেদায়েতপ্রাপ্তি ও ইল্ম অর্জনের পর ঘটে থাকে তাহলে তার অন্তরটি উল্টে যায়; অর্থাৎ উপরের অংশ নীচে চলে যায়। তখন শয়তান তার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে পরিচালনা করে।
দুই:
আপনি বলেছেন: “আপনি হজ্জ আদায় করেছেন, কিন্তু হজ্জ কবুল হওয়ার কোন আলামত দেখেননি। বরং আরও বেশি পাপ করেছেন” এর উত্তরে বলা যায়: আমল কবুলের বিষয়টি আল্লাহ্র কাছে। কেউ এ নিশ্চয়তা দেয়ার সাধ্য রাখে না যে, আপনার আমল কি কবুল হয়েছে; নাকি হয়নি?
মুমিন নেক আমল করে যায়, কিন্তু সে জানে না আমলটি কি আল্লাহ্ কবুল করেছেন; নাকি কবুল করেননি?
এমনকি ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন: আমি যদি জানতে পারতাম যে, আল্লাহ্ আমার একটি নেক আমল কবুল করেছেন তাহলে মৃত্যু আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় গায়েবী বিষয় হত। কেননা আল্লাহ্ বলেছেন: “তিনি শুধু মুত্তাকীদের আমল কবুল করেন”।
মানুষের কর্তব্য হচ্ছে– বেশি বেশি নেক আমল করা, আমলটি যেন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মোতাবেক হয় সেজন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করা। এর মাধ্যমে সে ব্যক্তি তার দায় সম্পন্ন করল। এরপর সে আল্লাহ্র কাছে কবুল হওয়ার জন্য প্রার্থনা করবে।
প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আপনি যদি হজ্জের নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে বিরত থেকে সহিহভাবে হজ্জ করে থাকেন তাহলে পুনরায় হজ্জ আদায় করা আপনার উপর আবশ্যকীয় নয়। আপনি পাপে লিপ্ত হওয়ার সাথে হজ্জ শুদ্ধ হওয়া বা না-হওয়া সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু, পাপের কারণে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন। অতএব, সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে অবিলম্বে তওবা করে নিন।
তিন: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, আপনি তাওয়াফ করছিলেন, এরপর প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে ছাদে উঠেছেন। এ মাসয়ালাটি হচ্ছে– ‘তাওয়াফের মধ্যে পরম্পরা রক্ষা করা’ সংক্রান্ত মাসয়ালা। স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে সমজাতীয় একটি প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তাঁরা বলেন: “তাওয়াফ স্থগিত করে উপরের তলা দিয়ে বাকী তাওয়াফ সম্পন্ন করতে কোন অসুবিধা নেই”।[ফাতাওয়াল লাজনাহ্ আদ-দায়িমা (১১/২৩০, ২৩১, ২৩২)]
তাওয়াফ শুরু করতে হবে ঠিক যেই স্থানে তাওয়াফ স্থগিত করেছিল ঐ স্থান থেকে। স্থানটি নির্ধারণ করার জন্য আপনি যে চেষ্টা করেছেন সে সম্পর্কে বলব: যদি কেউ একীন বা নিশ্চিত তথ্যে পৌঁছতে না পারে তাহলে সে ব্যক্তি প্রবল ধারণার ভিত্তিতে আমল করতে পারেন। যেহেতু ‘যে ব্যক্তি নামাযের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেছেন সে কি তিন রাকাত পড়েছেন না চার রাকাত’ তার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সে ব্যক্তি সঠিকটা জানার চেষ্টা করবে। তারপর ওটাকে- চেষ্টা লদ্ধ জ্ঞানকে- ভিত্তি করে নামায পূর্ণ করবে। এরপর সালাম ফিরাবে এবং সালাম ফিরানোর পর দুটো সিজদা দিবে”।[সহিহ বুখারী (৪০১) ও সহিহ মুসলিম (৫৭২), আল-শারহুল মুমতি (৩/৪৬১)]
এই আলোচনার আলোকে বলা যায়, আপনার ছাদে উঠে তাওয়াফ সমাপ্ত করা এবং তাওয়াফ শুরু করার সময় স্থগিত করার স্থান কোনটি সেটা জানার জন্য চেষ্টা করা: এ সংক্রান্ত বিষয়ে ইনশাআল্লাহ্ আপনার উপর কোন কিছু আবশ্যক নয়।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ