এক. কুরআনে কারীম:
ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন: ইমাম শাফেয়ি এবং যারা তাঁর সাথে একমত পোষণ করেছেন তারা সবাই এ আয়াত দিয়ে হস্তমৈথুন হারাম হওয়ার পক্ষে দলিল দিয়েছেন। আয়াতটির ভাবানুবাদ হচ্ছে-
“আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে হেফাযত করে। নিজেদের স্ত্রী বা মালিকানাভুক্ত দাসীগণ ছাড়া; এক্ষেত্রে (স্ত্রী ও দাসীর ক্ষেত্রে) অবশ্যই তারা নিন্দিত নয়। যারা এর বাইরে কিছু কামনা করবে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী।”[সূরা মুমিনুন, আয়াত: ৫-৬]
ইমাম শাফেয়ি ‘নিকাহ অধ্যায়ে’ বলেন: ‘স্ত্রী বা দাসী ছাড়া অন্য সবার থেকে লজ্জাস্থান হেফাযত করা’ উল্লেখ করার মাধ্যমে স্ত্রী ও দাসী ছাড়া অন্য কেউ হারাম হওয়ার ব্যাপারে আয়াতটি সুস্পষ্ট। এরপরও আয়াতটিকে তাগিদ করতে গিয়ে আল্লাহ্ তাআলা বলেন (ভাবানুবাদ): “যারা এর বাইরে কিছু কামনা করবে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী।” সুতরাং স্ত্রী বা দাসী ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গ ব্যবহার করা বৈধ হবে না, হস্তমৈথুনও বৈধ হবে না। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।[ইমাম শাফেয়ি রচিত ‘কিতাবুল উম্ম’]
কোন কোন আলেম এ আয়াত দিয়ে দলিল দেন: “যারা বিবাহে সক্ষম নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন।”[সূরা নূর, আয়াত: ৩৩] এ আয়াতে সংযমের নির্দেশ দেয়ার দাবী হচ্ছে– অন্য সবকিছু থেকে ধৈর্য ধারণ করা।
দুই. সুন্নাহ্:
আলেমগণ এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) এর হাদিস দিয়ে দলিল দেন যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমরা এমন কিছু যুবকে ছিলাম যাদের কিছু ছিল না। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যকার যার باءة (বিয়ের খরচ বহন ও শারীরিক সামর্থ্য) রয়েছে সে যেন বিয়ে করে ফেলে। কেননা, তা তার দৃষ্টি নিম্নগামী রাখতে ও লজ্জাস্থানকে হেফাজত করায় সহায়ক হয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না, সে যেন রোজা রাখে। কারণ তা যৌন উত্তেজনা প্রশমনকারী।”[সহীহ বুখারী (৫০৬৬)]
শরিয়ত প্রণেতা, বিয়ে করতে অক্ষম হলে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও রোযা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। হস্তমৈথুন করার পরামর্শ দেননি। যদিও হস্তমৈথুনের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে, হস্তমৈথুন করা রোযা রাখার চেয়ে সহজ। কিন্তু তদুপরি তিনি সে অনুমতি দেননি।
এ মাসয়ালায় আরও অনেক দলিল আছে। আমরা এ দলিলগুলো উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করছি।
হস্তমৈথুনে লিপ্ত ব্যক্তি কিভাবে এর থেকে মুক্তি পেতে পারেন এ সম্পর্ক নিম্নে আমরা কিছু উপদেশ ও পদক্ষেপ উল্লেখ করব:
১। এই অভ্যাস থেকে বাঁচার প্রেরণা যেন হয় আল্লাহ্র নির্দেশ পালন ও তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।
২। স্থায়ী সমাধান তথা বিয়ের মাধ্যমে এ অভ্যাসকে প্রতিরোধ করা। কারণ এটাই ছিল যুবকদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ।
৩। নানা রকম কু-চিন্তা ও খারাপ ভাবনা থেকে দূরে থাকা। দুনিয়া বা আখেরাতের কল্যাণকর চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কারণ কু-চিন্তাকে বাড়তে দিলে সেটা এক পর্যায়ে কর্মের দিকে নিয়ে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রয়ের বাইরে গিয়ে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন তা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
৪। দৃষ্টিকে নত রাখা। কারণ কোন ব্যক্তি বা অশ্লীল ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করা, সেটা জীবিত মানুষের হোক কিংবা আঁকা হোক, বাঁধহীন দৃষ্টি ব্যক্তিকে হারামের দিকে নিয়ে যায়। এ কারণে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: “মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে”[সূরা নূর, আয়াত: ৩০] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তুমি দৃষ্টির পর দৃষ্টি দিবে না”[সুনানে তিরমিযি (২৭৭৭), আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন] তাই প্রথম দৃষ্টি, যে দৃষ্টি হঠাৎ করে পড়ে যায় সেটাতে গুনাহ না থাকলেও দ্বিতীয় দৃষ্টি হারাম। এছাড়া যে সব স্থানে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার উপকরণ বিদ্যমান থাকে সেসব স্থান থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
৫। নানাবিধ ইবাদতে মশগুল থাকা। পাপকাজ সংঘটিত হওয়ার মত কোন অবসর সময় না রাখা।
৬। এ ধরণের কু-অভ্যাসের ফলে যেসব শারীরিক ক্ষতি ঘটে থাকে সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। যেমন- দৃষ্টিশক্তি ও স্নায়ুর দুর্বলতা, প্রজনন অঙ্গের দুর্বলতা, মেরুদণ্ডের ব্যথা ইত্যাদি যেসব ক্ষতির কথা চিকিৎসকরা উল্লেখ করে থাকেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন মানসিক ক্ষতি; যেমন- উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মানসিক পীড়া অনুভব করা। এর চেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে- নামায নষ্ট করা। যেহেতু বারবার গোসল করা লাগে, যা করা কঠিন। বিশেষতঃ শীতের রাত্রিতে। অনুরূপভাবে রোযা নষ্ট করা।
৭। ভুল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি পরিতুষ্টি দূর করা। কারণ কিছু কিছু যুবক ব্যভিচার ও সমকামিতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার ধুয়া তুলে এই কু-অভ্যাসকে জায়েয মনে করে। অথচ হতে পারে সে যুবক ব্যভিচার ও সমকামিতার নিকটবর্তী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই।
৮। কঠিন ইচ্ছা ও শক্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। শয়তানের কাছে হার না মানা। একাকী না থাকা; যেমন একাকী রাত কাটানো। হাদিসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষকে একাকী রাত কাটাতে নিষেধ করেছেন।[মুসনাদে আহমাদ, হাদিসটি ‘সহিহুল জামে’ তে রয়েছে]
৯। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত প্রতিকার পদ্ধতি গ্রহণ করা; সেটা হচ্ছে– রোযা রাখা। কেননা রোযা যৌন উত্তেজনাকে প্রশমিত করে এবং যৌন চাহিদাকে পরিশীলিত করে। এর সাথে উদ্ভট আচরণ থেকে সাবধান থাকা; যেমন- হস্তমৈথুন পুনরায় না করার ব্যাপারে শপথ করা কিংবা মানত করা। কারণ যদি কেউ পুনরায় করে ফেলে তাহলে সে ব্যক্তি পাকাপোক্ত-শপথ ভঙ্গকারী হিসেবে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে যৌন উত্তেজনা নিরোধক ঔষধ সেবন না করা। কেননা এসব ঔষধ সেবনে শারীরিক ঝুঁকি আছে। তাছাড়া যৌন উত্তেজনা একেবারে নিঃশেষ করে ফেলে এমন কিছু সেবন করা থেকে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা সাব্যস্ত হয়েছে।
১০। ঘুমানোর সময় ইসলামী আদবগুলো মেনে চলা। যেমন- ঘুমানোর দোয়াগুলো পড়া, ডান পার্শ্বে কাত হয়ে শোয়া, পেটের উপর ভর দিয়ে না-ঘুমানো; যেহেতু এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিষেধ আছে।
১১। ধৈর্য ও সংযমের গুণে নিজেকে ভূষিত করা। কারণ হারাম কাজ থেকে ধৈর্য রাখা আমাদের উপর ফরয; যদিও আমাদের মাঝে সেগুলো করার চাহিদা থাকে। আমাদের জানা উচিত, যদি আমরা নিজেকে সংযমী রাখার চেষ্টা করি তাহলে পরিশেষে সেটা ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য আখলাকে পরিণত হবে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি সংযম অবলম্বন করে আল্লাহ্ তাকে সংযমী বানিয়ে দিবেন, যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষী থাকার চেষ্টা করবেন আল্লাহ্ তাকে অমুখাপেক্ষী বানিয়ে দিবেন, যে ব্যক্তি ধৈর্য রাখার চেষ্টা করবেন আল্লাহ্ তাকে ধৈর্যশীল বানিয়ে দিবেন। কোন মানুষকে ধৈর্যের চেয়ে প্রশস্ত ও কল্যাণকর আর কোন দান দেয়া হয়নি।”[সহিহ বুখারী (১৪৬৯)]
১২। কেউ যদি এই গুনাহটি করে ফেলে তাহলে তার উচিত অনতিবিলম্বে তওবা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, নেকীর কাজ করা এবং ক্ষমাপ্রাপ্তির ব্যাপারে হতাশ না হওয়া। কেননা এ পাপটি একটি কবিরা গুনাহ।
১৩। সর্বশেষ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র কাছে ধর্ণা দেয়া, দোয়ার মাধ্যমে তাঁর কাছে মিনতি করা, তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এই কু-অভ্যাস থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায়। কেননা আল্লাহ্ তাআলা দোয়াকারীর ডাকে সাড়া দেন। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।