মানুষ সৃষ্টির হেকমত বা গুঢ় রহস্য কি?
মানুষ সৃষ্টির হেকমত
প্রশ্ন: 45529
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
এক:
আল্লাহ তাআলা “হিকমত” বা প্রজ্ঞার গুণে গুণান্বিত। তাঁর মহান নামের মধ্যে রয়েছে- “আল-হাকিম” বা প্রজ্ঞাবান। জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ তাআলা কোন কিছু অনর্থক সৃষ্টি করেননি। বরং তিনি অনর্থক কোন কিছু করা থেকে পবিত্র। বরং তিনি মহান হিকমত ও সার্বিক কল্যাণের ভিত্তিতে সৃষ্টি করে থাকেন। এ হেকমত কেউ জানে; কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মানুষকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আসমান ও জমিন অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা কি মনে কর আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি। তোমরা আমার নিকট প্রর্ত্যাবর্তন করবে না। সত্যিকার বাদশা আল্লাহ মহান হোন। তিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই; যিনি মহান আরশের অধিপতি।”[সূরা মুমিনূন, আয়াত: ১১৫, ১১৬] আল্লাহ তাআলা বলেন: “আসমান-জমিন এবং এ দুইটির মাঝে যা কিছু আছে সে সব আমি তামাশা করে সৃষ্টি করিনি।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ১৬] আল্লাহ আরও বলেন: “আমি আসমান-জমিন আর এ দুটির মাঝে যা আছে সে সব তামাশা করে সৃষ্টি করিনি। আমি ও দুটিকে যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।”[সূরা দুখান, আয়াত: ৩৮, ৩৯] তিনি আরও বলেন: “হা-মীম। এই কিতাব পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। নভোমন্ডল, ভূ-মন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু আমি যথাযথভাবেই এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছি। কাফেরদেরকে যে বিষয়ে সাবধান করা হয়েছে তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”[সূরা আহকাফ, আয়াত: ১-৩]
মানুষ সৃষ্টির হেকমত শরয়ি দলিল দ্বারা যেমন সাব্যস্ত তেমনি যৌক্তিকভাবে সাব্যস্ত। সুতরাং যে কোন বিবেকবান মানুষ এটি মানতে বাধ্য যে, সবকিছু বিশেষ হেকমতের প্রেক্ষিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিবেকবান মানুষ ব্যক্তিগত জীবনেও কোন কিছু কারণ ছাড়া করা থেকে নিজের পবিত্রতা ঘোষণা করে। সুতরাং মহান প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে আমরা কি ভাবতে পারি?!
তাইতো বিবেকবান মুমিনগণ আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি-রহস্য সাব্যস্ত করে থাকেন। আর কাফেরেরা সেটা অস্বীকার করে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে। যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০-১৯১] সৃষ্টি সম্পর্কে কাফেরদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন: “আমি আসমান-যমীন ও এ দু’ এর মধ্যে যা কিছু আছে তা অনর্থক সৃষ্টি করিনি। এ রকম ধারণা তো কাফিররা করে, কাজেই কাফিরদের জন্য আছে জাহান্নামের দূর্ভোগ।”[সূরা স্বাদ, আয়াত: ২৭]
শাইখ আব্দুর সাদী (রহঃ) বলেন:
আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিন সৃষ্টির মহান হেকমত সম্পর্কে অবহিত করছেন যে, তিনি এ দুটি উদ্দেশ্যহীনভাবে অনর্থক বা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি।
“এ রকম ধারণা তো কাফিররা করে” অর্থাৎ এ রকম ধারণা কাফেরেরা তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে করে। যে ধারণা তাঁর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
“কাজেই কাফিরদের জন্য আছে জাহান্নামের দূর্ভোগ” জাহান্নাম হকভাবে তাদেরকে পাকড়াও করবে এবং চরমভাবে পাকড়াও করবে। আল্লাহ তাআলা এ আসমান ও জমিনকে হকভাবে তথা ন্যায্যভাবে সৃষ্টি করেছেন, ন্যায়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ দুটি সৃষ্টি করে বান্দাকে তাঁর মহান জ্ঞান, ক্ষমতা ও অবাধ পরাক্রমশালিতা জানাতে চেয়েছেন এবং জানাতে চেয়েছেন যে, তিনিই একমাত্র মাবুদ বা উপাসনার পাত্র; যারা আসমান-জমিনের একটি বিন্দুও সৃষ্টি করেনি তারা উপাসনার যোগ্য নয়। আরও জানাতে চেয়েছেন যে, পূনরূত্থান হক বা সত্য। অচিরেই আল্লাহ তাআলা নেককার ও বদকারদের মধ্যে ফয়সালা করবেন। আল্লাহর হেকমত সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তি যেন মনে না করে যে, আল্লাহ উভয়ের সাথে সমান আচরণ করবেন। তাইতো আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে আমি কি তাদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের (কাফেরদের) সমতুল্য গণ্য করব? নাকি আমি মুত্তাকিদেরকে পাপাচারীদের সমান গণ্য করব।”[সূরা স্বাদ, আয়াত: ২৮] উভয়ের সাথে সমান আচরণ আল্লাহর হেকমত ও তাঁর বিধান বিরোধী। সমাপ্ত [তাফসিরে সাদী, পৃষ্ঠা- ৭১২]
দুই:
চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু পানাহার ও বংশবৃদ্ধির জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ মানুষকে সম্মানিত করেছেন। অনেক সৃষ্টির উপর আল্লাহ মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কুফরিকে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং যে মহান উদ্দেশ্যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাকে তারা বেমালুম ভুলে গেছে বা অস্বীকার করেছে। তাদের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে- দুনিয়াকে উপভোগ করা। এদের জীবন চতুষ্পদ জন্তুর জীবনের মত। বরং তারা চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে অধম। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যারা কুফরি করে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে আর আহার করে যেভাবে আহার করে চতুষ্পদ জন্তু জানোয়াররা।”[সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১২] তিনি আরও বলেন, “ছেড়ে দাও ওদেরকে, ওরা খেতে থাক আর ভোগ করতে থাক, আর (মিথ্যে) আশা ওদেরকে উদাসীনতায় ডুবিয়ে রাখুক, শীঘ্রই ওরা (ওদের আমলের পরিণতি) জানতে পারবে।”।[সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৩] তিনি আরও বলেন: “আমি বহু সংখ্যক জ্বীন আর মানুষকে দোযখের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের অন্তর আছে কিন্তুতা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তুতা দিয়ে তারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে কিন্তুতা দিয়ে শোনে না, তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারা একেবারে বে-খবর।”[সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৭৯] বিবেকবান সবাই জানে যে, যে ব্যক্তি কোন কিছু তৈরী করেন তিনি এর হেকমত সম্পর্কে অন্যের তুলনায় ভাল জানেন। আর আল্লাহর জন্য উত্তম উদাহরণ প্রযোজ্য, যেহেতু তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ সৃষ্টির হেকমত সম্পর্কে তিনিই ভাল জানবেন। দুনিয়াবি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটা যে সঠিক এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। মানুষ নিশ্চিত যে, তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ একটা হেকমত বা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। চক্ষু সৃষ্টি করা হয়েছে দেখার জন্য। কান সৃষ্টি করা হয়েছে শুনার জন্য। এভাবে প্রত্যেকটি অঙ্গ। এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, মানুষের প্রত্যেকটি অঙ্গ বিশেষ একটা উদ্দেশ্যেসৃষ্টি করা হয়েছে আর মানব সত্ত্বাকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে?! অথবা যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি যখন তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন তখন সে সেটা গ্রহণ করতে নারাজ?!
তিন:
আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, তিনি আসমান-জমিন, জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য- কে তাঁর আনুগত্য করে যাতে তাকে পুরস্কৃত করতে পারেন; আর কে তাঁর অবাধ্য হয় যাতে তাকে শাস্তি দিতে পারেন। তিনি বলেন: “যিনি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি মহা শক্তিধর, অতি ক্ষমাশীল।”[সূরা আল-মুল্ক, আয়াত: ২]
এ পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রভাব ফুটে উঠে। যেমন-‘আল-রহমান’, ‘আল-গফুর’, ‘আল-হাকিম’, ‘আল-তাওয়াব’, ‘আল-রহীম’ ইত্যাদি আল্লাহর গুণবাচক নাম।
সবচেয়ে যে মহান উদ্দেশ্য ও মহা পরীক্ষার জন্য মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা হচ্ছে- তাওহীদ বা নিরংকুশভাবে এক আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ প্রদান করা। আল্লাহ নিজেই মানুষ সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আমি জিন্ন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ‘ইবাদাত করবে।”[সূরা যারিয়াত, আয়াত: ৫৬]
ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন:
অর্থাৎ আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদেরকে আমার ইবাদতের নির্দেশ প্রদান করার জন্য; তাদের প্রতি আমার মুখাপেক্ষিতার কারণে নয়। আলি বিন আবু তালহা ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, “একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য” অর্থাৎ যাতে তারা ইচ্ছাই বা অনিচ্ছায় আমার ইবাদতের স্বীকৃতি দেয়। এটি ইবনে জারীরের নির্বাচিত তাফসির। ইবনে জুরাইয বলেন: যাতে তারা আমাকে চিনে। আল-রাবি বিন আনাস বলেন: “একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য” অর্থাৎ ইবাদতের জন্য। সমাপ্ত [তাফসিরে ইবনে কাছির (৪/২৩৯)]
শাইখ আব্দুর রহমান আল-সাদী (রহঃ) বলেন:
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য, তাঁর নাম ও গুণাবলির মাধ্যমে তাঁকে চেনার জন্য এবং তিনি তাঁকে সে নির্দেশ দিয়েছেন। যে ব্যক্তি তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল হবে এবং নির্দেশ পালন করবে সে সফলকাম। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিবে সে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদেরকে এমনস্থানে সম্মিলিত করা অনিবার্য যেখানে তিনি তাদেরকে তার আদেশ-নিষেধ পালনের ভিত্তিতে প্রতিদান দিতে পারবেন। এ কারণে মুশরিকদের প্রতিদানকে অস্বীকার করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যদি আপনি তাদেরকে বলেন যে, নিশ্চয় তোমাদেরকে মৃত্যুর পরে জীবিত ওঠানো হবে, তখন কাফেরেরা অবশ্য বলে এটা তো স্পষ্ট যাদু!"[সূরা হুদ, আয়াত: ০৭] অর্থাৎ যদি আপনি এদেরকে বলেন এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের ব্যাপারে সংবাদ দেন তারা আপনার কথায় বিশ্বাস করবে না। বরং আপনাকে তীব্রভাবে মিথ্যায়ন করবে এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন সেটার উপর অপবাদ দিবে। তারা বলবে: “এটা তো স্পষ্ট যাদু”
জেনে রাখুন এটা স্পষ্ট সত্য। সমাপ্ত [তাফসিরে সাদী, পৃষ্ঠা- ৩৩৩]
আল্লাহই ভাল জানেন।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব