আমি জুমার নামাযে উপস্থিত হলাম। যখনি কোন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করেন তিনি সালাম দেন; অন্য মুসল্লিরা সালামের উত্তর দেয়। এমন কি যারা কুরআন শরিফ পড়েন তারাও উত্তর দেন। এরপর যখন খোতবা শুরু হল তখনও কিছু কিছু মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং সালাম দিলেন। ইমাম সাহেব নিম্নস্বরে তাদের সালামের জবাব দিলেন। এটা করা কি জায়েয?
জুমার খোতবার সময় চুপ থাকা ও কথা বলার বিধান
প্রশ্ন: 45651
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
জুমার নামাযে উপস্থিত ব্যক্তিদের উপর নীরবতা পালন করে ইমামের খোতবা শুনা ফরজ। অন্যের সাথে কথা বলা নাজায়েয। এমনকি সে কথা যদি অন্যকে চুপ করানোর জন্যে হয় সে কথাও। যে ব্যক্তি এমন কিছু করল সে অনর্থক কাজ করল। আর যে ব্যক্তি অনর্থক কাজ করল তার জুমা নেই।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “জুমার দিন ইমাম খোতবাদানকালে আপনি যদি পাশের কাউকে বলেন:‘চুপ থাকুন’ তাহলে আপনি জুমার সওয়াব নষ্ট করে দিলেন।” [সহিহ বুখারি (৮৯২) ও সহিহ মুসলিম (৮৫১)]
এই নিষেধাজ্ঞা শরিয়ত অনুমোদিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানকেও অন্তর্ভুক্ত করবে; অন্য দুনিয়াবি বিষয়গুলোকে তো করবেই।
আবুদ দারদা (রাঃ) বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বারে বসে মানুষের উদ্দেশ্যে খোতবা দিচ্ছিলেন। তিনি একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আমার পাশে ছিল উবাই ইবনে কাব। আমি তাঁকে বললাম: উবাই; এ আয়াতটি কখন নাযিল হয়েছে? তিনি আমার সাথে কোন সাড়া দিলেন না। আমি এরপরেও তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তারপরেও তিনি কোন সাড়া দিলেন না। এক পর্যায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মিম্বার থেকে নামলেন তখন উবাই আমাকে বললেন: তুমি যে অনর্থক কথা বলেছ সেটা ছাড়া তুমি জুমার কোন সওয়াব পাবে না। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায শেষ করলেন তখন আমি তাঁর কাছে এসে বিষয়টি জানালাম: তখন তিনি বললেন, উবাই ঠিক বলেছে। যখন ইমাম কথা বলা শুরু করে তখন ইমাম কথা শেষ করা পর্যন্ত চুপ থাকবে”।[মুসনাদে আহমাদ (২০৭৮০), সুনানে ইবনে মাজাহ (১১১১), আল-বুসিরি হদিসটিকে সহিহ বলেছেন, অনুরূপভাবে আলবানীও ‘তামামুল মিল্লাহ’ গ্রন্থে (৩৩৮) সহিহ বলেছেন]
এ হাদিসটি প্রমাণ করে যে, জুমার দিন ইমামের খোতবাকালে নিরবতা পালন করা ফরজ এবং কথা বলা হারাম।
ইবনে আব্দুল বার বলেন:
ফিকাহবিদদের মাঝে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, যে ব্যক্তির কানে খোতবার শব্দ পৌঁছে তার উপর চুপ থাকা ফরজ।[আল-ইসতিযকার (৫/৪৩)]
খোতবার সময় চুপ থাকার হুকুম উল্লেখ করতে গিয়ে ইবনে রুশদ বলেন:
যারা বলেন, ‘জুমার খোতবা চলাকালে চুপ থাকা ফরজ নয়’ আমি তাদের মতের পক্ষে কোন ওজুহাত পাই না। তবে তারা যদি মনে করেন যে, এ নির্দেশটি কুরআনের আয়াতের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক তাহলে হতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বলেন: “যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয় তখন কুরআন শুন এবং চুপ থাক”[সূরা আরাফ, আয়াত: ২০৪] এর মানে কুরআন ছাড়া অন্য কিছুর জন্য চুপ থাকা ফরজ নয়। তবে এ ধরণের দলিল দুর্বল। আল্লাহই ভাল জানেন। অধিক সম্ভাবনা হচ্ছে- এ মতের প্রবক্তাদের নিকট হাদিসটি পৌঁছেনি।[বিদায়াতুল মুজাতাহিদ (১/৩৮৯) থেকে সমাপ্ত]
এ বিধান থেকে বাদ পড়বে- প্রয়োজনে কিংবা কল্যাণার্থে ইমামের সাথে কথা বলা এবং মোক্তাদিদের সাথে ইমামের কথা বলা।
আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সে সময় একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার খোতবা দিচ্ছিলেন, সে মুহূর্তে একজন বেদুইন দাঁড়িয়ে বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজন ক্ষুধায় কাতর। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন। তখন তিনি দুই হাত তুললেন…। তাঁর দুআর ফলে সেদিন বৃষ্টি নামল, এর পরের দিনও বৃষ্টি হল, এর পরের দিন, এর পরের দিনও বৃষ্টি হল, পরবর্তী শুক্রবার পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকল। সেই জুমাতে একই বেদুইন অথবা অন্য একজন দাঁড়িয়ে বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যাচ্ছে। সম্পদ ডুবে যাচ্ছে। আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন। তখন তিনি দু হাত তুললেন…[সহিহ বুখারী (৮৯১) ও সহিহ মুসলিম (৮৯৭)]
জাবের বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার দিন খোতবাদানকালে এক ব্যক্তি (নামাযে) এল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন: ওহে অমুক, তুমি কি নামায পড়েছ? সে বলল: না। তিনি বললেন: দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামায পড়ে নাও।[সহিহ বুখারী (৮৮৮) ও সহিহ মুসলিম (৮৭৫)]
যারা এ ধরণের হাদিসগুলো দিয়ে মুসল্লিদের পারষ্পারিক কথা বলা জায়েয হওয়া কিংবা নিরবতা পালন করা ওয়াজিব না হওয়ার পক্ষে দলিল দেন তাদের অভিমত সঠিক নয়।
ইবনে কুদামা বলেন:
তারা যে হাদিসগুলো দিয়ে দলিল দেন সে হাদিসগুলো কোনটি ইমামের সাথে কথা বলার সাথে খাস; আর কোনটি মুসল্লির সাথে ইমামের কথা বলার সাথে খাস। এতে করে খোতবা শুনায় কোন ব্যাঘাত ঘটে না। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন যে, তুমি কি নামায পড়েছ? সে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের জবাব দেন। অনুরূপভাবে উসমান (রাঃ) খোতবা প্রদানকালে উমর (রাঃ) তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি প্রশ্নের জবাব দেন। তাই এ ধরণের হাদিসগুলোকে এ অর্থে গ্রহণ করা অনিবার্য; যাতে করে সবগুলো হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায়। অন্য কোন অবস্থাকে এর উপর কিয়াস করা সহিহ হবে না। কারণ খোতবা প্রদানকালে তো ইমামের অন্য কোন কথা বলার সুযোগ নেই; যেমনটি মোক্তাদিদের সুযোগ আছে।[সমাপ্ত; আল-মুগনি (২/৮৫)]
পক্ষান্তরে, খোতবা চলাকালে হাঁচির উত্তর দেয়া ও সালামের জবাব দেয়ার মাসয়ালায় আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন।
ইমাম তিরমিযি তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস “যদি আপনি আপনার পাশের লোককে বলেন…” বর্ণনা করার পর বলেন: সালামের জবাব দেয়া ও হাঁচির উত্তর দেয়ার ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। কোন কোন আলেম জুমার খোতবা চলাকালে সালামের জবাব দেয়া ও হাঁচির উত্তর দেয়ার ব্যাপারে ছাড় দেন। এটি ইমাম আহমাদ ও ইসহাকের অভিমত। তাবেয়ীদের মধ্যে কিছু আলেম ও অন্যান্য কিছু আলেম একে মাকরূহ বলেছেন। এটি ইমাম শাফেয়ীর অভিমত।[সমাপ্ত]
স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্রতে (৮/২৪২) এসেছে:
আলেমগণের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, খোতবা চলাকালে হাঁচির উত্তর দেয়া ও সালামের জবাব দেয়া জায়েয নয়। কেননা হাঁচির উত্তর ও সালামের জবাব কথার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হাদিসের সাধারণ ভাবের দলিলের ভিত্তিতে খোতবা চলাকালে সব ধরণের কথা বলা নিষিদ্ধ।
স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্রতে (৮/২৪৩) আরও এসেছে-
ইমাম খোতবা প্রদানকালে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে যদি খোতবার শব্দ শুনা যায় তাহলে উপস্থিত মুসল্লিদেরকে সালাম দেয়া জায়েয নেই। আর যারা মসজিদে আছে ইমামের খোতবা চলাকালে তাদের পক্ষ থেকেও সালামের জবাব দেয়া জায়েয নয়।
ফতোয়া সমগ্রতে (৮/২৪৪) আরও এসেছে-
জুমারদিন খতীবের খোতবা চলাকালে কথা বলা জায়ে নয়; তবে উদ্ভূত কোন বিষয়ে খতীবের সাথে কথা বলতে হলে সেটা জায়েয আছে।[সমাপ্ত]
শাইখ উছাইমীন বলেন:
জুমার খোতবা চলাকালে সালাম দেয়া হারাম। অতএব, ইমামের খোতবা চলাকালে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল তার জন্য সালাম দেয়া জায়েয নয় এবং অন্যদের সে সালামের উত্তর দেয়াও জায়েয নয়।[বিন উছাইমীনের ফতোয়াসমগ্র (১৬/১০০)]
শাইখ আলবানী বলেন:
কাউকে এ কথা বলা যে, ‘চুপ থাকুন’ আভিধানিক অর্থে অনর্থক কথা নয়। কারণ এটি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিকে অনর্থক কথা ও নাজায়েয হিসেবে উল্লেখ করেছেন। খোতবাকালে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথা ‘খোতবা শুনার জন্য নিরবতা পালন’কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি এটাকে অনর্থক কথা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং যেসব কাজ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের সমপর্যায়ভুক্ত সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। আর যদি সমপর্যায়ভুক্ত না হয়ে নিম্নপর্যায়ের হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সেটি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনর্থক ও নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।[আল-আজউয়িবা আন-নাফিআ (পৃষ্ঠা-৪৫)]
সারকথা:
জুমাতে উপস্থিত মুসল্লিদের উপর চুপ থেকে ইমামের খোতবা শুনা ফরজ। ইমাম খোতবা প্রদানকালে কথা বলা নাজায়েয। তবে দলিলের ভিত্তিতে যে কয়টি বিষয় এ বিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে না সেগুলো ছাড়া; যেমন- খতিবের সাথে কথা বলা, কিংবা খতিবের কথা জবাব দেয়া, কিংবা কোন অন্ধকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার মত জরুরী কোন বিষয় ঘটলে।
ইমামকে সালাম দেয়া ও ইমামের পক্ষ থেকে সালামের জবাব দেয়া এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ ইমামের সাথে কথা বলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে কোন প্রয়োজন কিংবা কল্যাণের স্বার্থে; এর মধ্যে সালাম দেয়া পড়ে না।
শাইখ উছাইমীন তাঁর রচিত ‘আল-শারহুল মুমতি’ (৫/১৪০) গ্রন্থে বলেন:
কোন কল্যাণের স্বার্থ ছাড়া ইমামের অন্য কোন কথা বলা নাজায়েয। কথা বললে সেটা নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কল্যাণের স্বার্থে কিংবা যে বিষয়ে তখন কথা বলাটা ভাল এমন কিছু হতে হবে। এমন কোন কল্যাণের বিষয় না হলে ইমামের কথা বলা নাজায়েয।
আর কোন প্রয়োজনের স্বার্থে কথা বলা আরও অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রয়োজনের মধ্যে পড়বে- শ্রোতা খোতবার কোন একটি বাক্য বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাসা করা। কিংবা খতিব কোন একটি আয়াতে এমন ভুল করলেন যা অর্থকে বিকৃত করে দেয় এক্ষেত্রে খতিবকে স্মরণ করিয়ে দেয়া।
কল্যাণের মর্যাদা প্রয়োজনের নিচে। কল্যাণের মধ্যে পড়বে- মাইক্রফোনে যদি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে ইমাম ইঞ্জিনিয়ারকে বলতে পারেন: ‘দেখুন তো মাইকে সমস্যা কি?’[সমাপ্ত]
আল্লাহই ভাল জানেন।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব