এক:
কিয়াম, রুকু ও সেজদা নামাযে রুকন (আবশ্যকীয় কাঠামো)। যে ব্যক্তির সক্ষমতা আছে তার জন্য শরিয়তের বর্ণিত কাঠামো অনুযায়ী এগুলো পালন করা ওয়াজিব (আবশ্যকীয়)। আর যে ব্যক্তি রোগের কারণে কিংবা বয়সের কারণে অক্ষম সেই ব্যক্তি ভূমিতে কিংবা চেয়ারে বসতে পারেন।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তোমরা নিয়মিতভাবে নামাযের হেফাযত কর। বিশেষতঃ মধ্যবর্তী নামায। আর আল্লাহ্র প্রতি বিনয়াবনত হয়ে দাঁড়াও।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৩৮]
ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “আমার অর্শ রোগ ছিল। সে প্রসঙ্গে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন: তুমি দাঁড়িয়ে নামায পড়বে; যদি দাঁড়াতে না পার তাহলে বসে পড়বে। যদি বসতে না পার তাহলে কাত হয়ে শুয়ে নামায পড়বে।”[সহিহ বুখারী (১০৬৬)]
ইবনে কুদামা আল-মাক্বদিসি বলেন:
“আলেমগণ এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, যেই ব্যক্তি দাঁড়াতে পারে না সে বসে নামায পড়বে।”[আল-মুগনী (১/৪৪৩)]
ইমাম নববী বলেন:
“উম্মাহ এই মর্মে ইজমা করেছে— যে ব্যক্তি ফরয নামাযে দাঁড়াতে অক্ষম সে বসে নামায পড়বে; তাকে নামায পুনরায় পড়তে হবে না। আমাদের মাযহাবের আলেমগণ বলেন: দাঁড়িয়ে নামায পড়ার সওয়াব থেকে তার সওয়াব কম হবে না। কেননা সেই ব্যক্তি ওজরগ্রস্ত। সহিহ বুখারীতে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যদি কোন বান্দা অসুস্থ হয় কিংবা সফরে থাকে সে সুস্থ ও মুকীম অবস্থায় যে আমল করত তার জন্য তাই লেখা হবে।” [আল-মাজমু’ গ্রন্থে (৪/২০১)]
শাওকানী বলেন:
“ইমরান (রাঃ) এর হাদিস প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তির কোন ওজর ঘটেছে, যার কারণে সে দাঁড়াতে পারে না; তার জন্য বসে নামায পড়া জায়েয এবং যে ব্যক্তির এমন কোন ওজর ঘটেছে যার কারণে সে বসতে পারে না; তার জন্য কাত হয়ে শুয়ে নামায পড়া জায়েয।”[নাইলুল আওতার (৩/২৪৩)]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন:
“মুসলমানগণ এই মর্মে একমত যে, যে মুসল্লি নামাযের কিছু ওয়াজিব আদায় করতে অক্ষম; যেমন- দাঁড়ানো, তেলাওয়াত করা, রুকু করা, সেজদা করা, সতর ঢাকা কিংবা ক্বিবলামুখী হওয়া ইত্যাদি তাহলে সে যা করতে অক্ষম সেটা তার উপর থেকে মওকুফ হবে।”[মাজমুউল ফাতাওয়া (৮/৪৩৭) থেকে সমাপ্ত]
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে যেই ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বসে নামায পড়ে তার নামায বাতিল।
দুই:
এ বিষয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্চনীয়: যে ব্যক্তি দাঁড়ানো ত্যাগ করার ক্ষেত্রে ওজরগ্রস্ত; তার এই ওজর তার জন্য রুকু-সেজদাকালে চেয়ারে বসাকে বৈধ করবে না।
নামাযের ওয়াজিবসমূহের ক্ষেত্রে বিধি হলো: মুসল্লি যতটুকু করার সক্ষমতা রাখেন ততটুকু করা তার উপর ওয়াজিব। আর যা করতে অক্ষম ততটুকু তার উপর থেকে মওকুফ হবে।
যে ব্যক্তি দাঁড়াতে অক্ষম তার জন্য দাঁড়ানোর সময় চেয়ারে বসা জায়েয হবে; সে রুকু-সিজদা সঠিক কাঠামোতে আদায় করবে। আর যদি দাঁড়াতে সক্ষম হয়; কিন্তু রুকু-সেজদা দিতে কষ্ট হয়; তাহলে দাঁড়িয়ে নামায পড়বে, এরপর রুকু-সেজদাকালে চেয়ারে বসবে। এবং সেজদাকালে মাথাকে রুকুর চেয়ে বেশি নোয়াবে।
দেখুন: 9307 নং প্রশ্নোত্তর।
ইবনে কুদামা আল-মাক্বদিসি বলেন:
“যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম, রুকু কিংবা সেজদা দিতে অক্ষম: তার জন্য দাঁড়ানো মওকুফ হবে না। সে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায পড়বে। ইশারাতে রুকু করবে। এরপর বসবে এবং ইশারাতে সেজদা করবে। এটি ইমাম শাফেয়ি বলেছেন…। আল্লাহ্ তাআলার এ বাণী: “আর আল্লাহ্র প্রতি বিনয়বনত হয়ে দাঁড়াও”। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তুমি দাঁড়িয়ে নামায পড়বে”-র প্রেক্ষিতে। তাছাড়া যে ব্যক্তির দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে তার জন্য এটি রুকন (আবশ্যকীয় কাঠামো)। তাই তেলাওয়াতের মত এটি পালন করা আবশ্যকীয়। অন্য কোনটি পালনে অক্ষম হওয়া এটি মওকুফ হওয়াকে অনিবার্য করে না; যেমনিভাবে কেউ যদি তেলাওয়াত করতে অক্ষম হয়।”[আল-মুগনী (১/৪৪৪) থেকে সংক্ষেপে সমাপ্ত]
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায (রহঃ) বলেন:
যে ব্যক্তি ভূমিতে বসে বা চেয়ার বসে নামায পড়ে তার উপর আবশ্যক হলো: তার সেজদাকে রুকুর চেয়ে নীচু করা। সুন্নাহ হলো: রুকুর সময় সে তার হাতদ্বয় তার হাঁটুর উপর রাখবে। আর সেজদা অবস্থায় ওয়াজিব হলো: সক্ষম হলে হাতদ্বয় ভূমিতে রাখা। আর সক্ষম না হলে হাতদ্বয় হাঁটুর উপর রাখা। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে সাতটি হাড্ডির উপর সেজদা করতে: কপাল, তিনি নাকের দিকে ইশারা করেন, হাতদ্বয়, হাঁটুদ্বয় এবং পায়ের আঙ্গুলের উপর।”
যে ব্যক্তি এভাবে করতে অক্ষম হওয়ায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করে তাতে কোন আপত্তি নেই। দলিল হলো আল্লাহ্ তাআলার বাণী: “তোমরা আল্লাহকে সাধ্যানুযায়ী ভয় কর”। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “আমি যখন তোমাদেরকে কোন আদেশ করি তখন তোমরা সাধ্যানুযায়ী সেটি পালন কর।”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম][ফাতাওয়া বিন বায (১২/১৪৫, ১৪৬)]
তিন:
চেয়ার কাতারে রাখা: আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, যে ব্যক্তি বসে নামায পড়ে তার ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো: তার নিতম্ব কাতারের সমান্তরালে হওয়া; কাতার থেকে আগে বা পিছে না হওয়া। কেননা এটাই হলো সেই স্থান যেখানে তার দেহ স্থিতিশীল হয়।
দেখুন: আসনাল মাতালিব (১/২২২), তুহফাতুল মুহতাজ (২/১৫৭), শারহু মুনতাহাল ইরাদাত (১/২৭৯)।
আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যাতে (৬/২১) এসেছে:
“ইক্বতিদা শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো (অর্থাৎ ইমামের পেছনে মোক্তাদির ইক্বতিদা): মোক্তাদি দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইমামের অগ্রবর্তী না হওয়া; এটি জমহুর ফিকাহবিদ (হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি) এর অভিমত।
অগ্রবর্তী হওয়া বা না-হওয়ার ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো: দণ্ডায়মান ব্যক্তির পায়ের গোড়ালি; আর তা হলো পায়ের পাতার পশ্চাদ্ভাগ; টাকনু নয়। যদি পায়ের গোড়ালি সমান্তরালে হয়; কিন্তু মোক্তাদির আঙ্গুল লম্বা হওয়ায় সামনে চলে যায়; এতে অসুবিধা নেই…। আর উপবিষ্টের ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো নিতম্ব। আর শয়নরত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পার্শ্বদেশ।”[সমাপ্ত]
তাই মুসল্লি যদি নামাযের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চেয়ারে বসে নামায পড়েন তাহলে তিনি তার বসার স্থানকে কাতারের সমান্তরাল করবেন।
যদি তিনি দাঁড়িয়ে নামায পড়েন; কিন্তু রুকু ও সেজদাকালে বসেন; এ সম্পর্কে আমরা ফাযিলাতুশ শাইখ আব্দুর রহমান আল-বার্রাককে জিজ্ঞেস করেছি: তিনি বলেন: ধর্তব্য হবে দাঁড়ানো অবস্থা। অতএব, সেই ব্যক্তি দাঁড়ানো অবস্থাকে কাতারের সমান্তরাল করবেন। এই অভিমতের ভিত্তিতে তখন চেয়ার কাতারের পেছনে থাকবে। তবে এমন স্থানে হওয়া উচিত যাতে করে পেছনের মুসল্লিরা কষ্ট না পায়।
আল্লাহ তাআলাই সর্বজ্ঞ।