আমি দ্বীনধর্ম মেনে চলি এমন একজন মেয়ে। আমার বয়স ২৭ বছর। হাফেজে কুরআন। হিফযখানাতে পড়াই। ইলমে দ্বীন অর্জন করি। আমার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যে কারণে অনেক যুবক আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তবে যারা প্রস্তাব দেয় তাদের দ্বীনদারির দুর্বলতার কারণে আমি সেসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই। উপর্যুপরি সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে আমি পারিবারিক চাপের মধ্যে আছি। তাছাড়া নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কারণে আমি আমার সরকারী চাকুরীটিও ছেড়ে দিয়েছি। এতে আমার উপর আরও চাপ বেড়েছে। এখন আমার পরিবার চায় আমি যেন যে কোন ছেলের সাথে বিয়েতে রাজী হয়ে যাই। বিয়ে হওয়াটাই মুখ্য। প্রথাগতভাবে গোত্রের বাইরে বিয়ে নিষিদ্ধ। আমি সম্পদ চাই না, কিংবা সম্পদশালী, বড় পদে চাকুরীজীবী বা সুদর্শন যুবক চাই না। আমি চাই একজন নেককার ছেলে; যে আমাকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে সাহায্য করবে, আমার চরিত্রের হেফাযত করবে। যাতে করে আমি আমার পরিবারের সাথে এসব সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারি। তাই চিন্তা করেছি আমার পরিচিতদের মধ্যে এক যুবককে প্রস্তাব পাঠাব। তার সাথে আমাদের বৈবাহিকসূত্রের আত্মীয়তা আছে। সে একজন চরিত্রবান ও দ্বীনদার যুবক। কুরআনে হাফেয ও তালেবে ইলম। আমি চাই আদব রক্ষা করে আকর্ষণীয় ভাষায় তাকে একটি মোবাইল মেসেজ পাঠাব। এই যুবকের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি ভুলক্রমে তার মোবাইল নম্বর জেনেছি। এ ইস্যুতে আমি তৃতীয় কোন পক্ষ কিংবা অপর কাউকে জড়াতে চাচ্ছি না। এতে করে এ ইস্যুটি উভয় পক্ষের জন্য সংকটপূর্ণ হয়ে যেতে পারে এবং বিষয়টি জানাজানি হয়ে যেতে পারে। এমন কাউকে পাচ্ছি না যার উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারি যে, সে বিষয়টি গোপন রাখবে। সুতরাং এক্ষেত্রে শরিয়তের হুকুম কি? দ্বিতীয়ত যে মেয়ে এমন একটি কাজ করতে যাচ্ছে তার ব্যাপারে আপনাদের মতামত কি? যে ছেলেকে এই মেয়ে সরাসরি প্রস্তাব দিবে সে মেয়ের ব্যাপারে এ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে? আপনারা আমাকে কি পরামর্শ দিবেন?
কোন পুরুষের চরিত্র ও দ্বীনদারিতে আকৃষ্ট হয়ে কোন নারী কি বিয়ের জন্য নিজেকে সে পুরুষের কাছে পেশ করতে পারে?
প্রশ্ন: 99737
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
এক:
আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আপনার উপর তার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দেন। আপনার ইলম, আদব ও লজ্জাশীলতা আরও বাড়িয়ে দেন। আমরা আরও দুআ করছি, আল্লাহ যেন আপনার জন্য একজন সৎ পাত্র সহজে মিলিয়ে দেন। যাতে করে আপনি তার সাথে নেক সংসার গড়ে তুলতে পারেন।
নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কারণে চাকুরীটি ছেড়ে দিয়ে আপনি ভাল কাজ করেছেন। বিয়ের প্রস্তাবক যুবকেরা চরিত্রবান ও দ্বীনদার না হওয়ায় তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেও আপনি ভাল কাজ করেছেন। আর এ যুবককে মেসেজ পাঠানোর আগে প্রশ্ন করেও আপনি উত্তম কাজটি করেছেন।
দুই:
বিয়ের জন্য কোন চরিত্রবান ও দ্বীনদার লোকের কাছে নিজেকে পেশ করা নারীর জন্যে হারাম নয় এবং বুদ্ধিমান লোকদের কাছে এটা দোষের কিছু নয়। কেউ যদি এটাকে খারাপ চোখে দেখে তাহলে তার সে দেখাটা শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়; বরং সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা ও অভ্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে। আবার অনেক সময় মহিলারা হিংসাবশত এটাকে খারাপ চোখে দেখে। সাবেত আল-বুনানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি আনাস (রাঃ) এর কাছে ছিলাম। তাঁর কাছে তাঁর মেয়ে ছিলেন। এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে নিজেকে (বিয়ের জন্য) পেশ করে বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কি আপনার প্রয়োজন আছে? আনাস (রাঃ) এর মেয়ে বললেন: ছি! ছি! তাঁর লজ্জাবোধ কতই কম! তখন আনাস (রাঃ) বললেন: সে মহিলা তোমার চেয়ে উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আগ্রহবশত তিনি তাঁর কাছে নিজেকে পেশ করেছেন।”[সহিহ বুখারী (৪৮২৮)] ইমাম বুখারী এ হাদিসের শিরোনাম দিয়েছেন “সৎ লোকের কাছে কোন নারীর নিজেই প্রস্তাব দেয়া শীর্ষক পরিচ্ছেদ”।
জনৈক সৎ নারী নিজে থেকে মুসা (আঃ) এর সাথে বিয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিতে গিয়ে বলেন: যেমনটি আল্লাহ তাআলা উদ্ধৃত করেছেন, “নারীদ্বয়ের একজন বলল, আব্বু, আপনি তাকে মজুর নিয়োগ করুন। কারণ আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সে ব্যক্তি যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।[সূরা কাসাস, আয়াত: ২৬] তবে আয়াত থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে- মেয়েটির পিতা তাকে মূসা (আঃ) এর নিকট উপস্থাপন করেছেন। যেমনটি বুঝা যায় এ কথা থেকে “তিনি মূসাকে বললেন: আমি আমার এ কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই, এ শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার মজুরি খাটবে।”[সূরা কাসাস, আয়াত: ২৭]
এটি আপনার অভিভাবকদের প্রতি একটা মেসেজ; যাতে করে তারা আল্লাহকে ভয় করে, গোত্রীয় গোঁড়ামি পরিত্যাগ করে এবং একজন সৎ পাত্রের কাছে আপনাকে বিয়ে দেয়। অন্ততঃ কোন চরিত্রবান ও দ্বীনদার পাত্রকে যেন তারা প্রত্যাখ্যান না করে। এই সৎ লোকের মেয়েটি ইঙ্গিত দেয়ার পর লোকটি নিজের মেয়েকে মূসা (আঃ) এর কাছে পেশ করলেন। অনুরূপভাবে জনৈক সৎ মহিলা ইঙ্গিতে নয়; বরং সরাসরি নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করেছেন। এ ঘটনাগুলো লজ্জাশীলতার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং এ ঘটনাগুলো মজবুত দ্বীনদারি, সংশ্লিষ্ট মহিলা ও তার অভিভাবকের বুদ্ধির প্রখরতার প্রমাণ বহন করে।
আল-মাওসূআ আল-ফিকহিয়্যা (৩০/৫০) গ্রন্থে এসেছে-
কোন পুরুষের দ্বীনদারি, মর্যাদা, ইলম, কিংবা বিশেষ কোন দ্বীনি বৈশিষ্ট্যে বিমোহিত হয়ে কোন নারীর জন্য নিজেকে সে পুরুষের কাছে উপস্থাপন করা ও পরিচয় তুলে ধরা জায়েয আছে; এতে দোষের কিছু নেই। বরং এটি সে নারীর মর্যাদারই প্রমাণ বহন করে। এ বিষয়ে সহিহ বুখারীতে সাবেত আল-বুনানী থেকে বর্ণনা এসেছে যে, তিনি বলেন: আমি আনাস (রাঃ) এর কাছে ছিলাম… এরপর পূর্ণাঙ্গ হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে। সমাপ্ত
তিন:
উপরোক্ত আলোচনার পর আমরা আপনাকে নিম্নলিখিত উপদেশগুলো দিচ্ছি; যে উপদেশগুলো আপনার কাজে আসবে ইনশাআল্লাহ।
১. আপনি সে ছেলেকে সরাসরি মেসেজ না পাঠিয়ে অপরিচিত অন্য কোন মোবাইল নম্বর থেকে মেসেজ করুন। যে নম্বরটি কেউ ব্যবহার করে না। এতে করে তাকে পাওয়া আপনার জন্য সহজ হবে। আপনি তার কাছে এভাবে একটি মেসেজ পাঠান যেন কেউ একজন আপনার ব্যাপারে তাকে সন্ধান দিচ্ছে; যদি তার বিয়ের আগ্রহ থাকে। মনে হবে মেসেজটি এমন এক পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে যে ব্যক্তি আপনাদের উভয়কে চিনে, এ মেয়েটির ব্যাপারে সে যেন অবহেলা না করে সে বিষয়ে তাকে উপদেশ দেয়া। আমাদের মতে, সরাসরি প্রস্তাব দেয়ার চেয়ে এটি উত্তম। কারণ হতে পারে বিষয়গুলো আপনার ইচ্ছামত না আগাতে পারে; এতে করে আপনার জন্য ও ছেলেটির জন্য এ বিষয়টি সংকটের কারণ হবে। অনুরূপভাবে মানুষ এ গ্যারান্টিও দিতে পারে না যে, সে ব্যক্তি তার বর্তমান এ দ্বীনদারির উপর সবসময় অটল, অবিচল থাকবে। তখন সে ব্যক্তি এ বিষয়টি তুলে আপনাকে তিরস্কার করতে পারেন। এ কারণে আলেমগণ “সৎ হওয়া” শর্ত করেছেন; শুধু ইলম থাকা ও কুরআন শরিফ মুখস্থ থাকাটা সৎ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সৎ হওয়ার অর্থ হচ্ছে- ইলম ও কুরআন অনুযায়ী আমল করা, এ দুটির নির্দেশিত চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া।
২. আপনি যদি তাকে মেসেজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন সেক্ষেত্রে আপনি উপর্যুপরি মেসেজ পাঠানো অব্যাহত রাখবেন না। বরং আমরা আপনাকে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের জন্য মেসেজ পাঠানোর বৈধতা দিচ্ছি। কারণ এ মেসেজগুলো সে ছেলের কিংবা আপনার কিংবা আপনাদের দুইজনের ফিতনাগ্রস্ত হওয়ার কারণ হতে পারে।
৩. মেসেজের বিষয়টি অন্য কাউকে অবহিত করবেন না, অন্য কারো সহযোগিতা নিবেন না। আমরা লক্ষ্য করেছি এদিকে আপনি সতর্ক আছেন।
৪. হতে পারে সে ছেলের পরিবেশ পরিস্থিতি বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত নয়। কিংবা হতে পারে সে অন্য মেয়েকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে; একাধিক বিয়ে করার ইচ্ছা নাই। আপনি যদি তার পক্ষ থেকে এমন কিছু জেনে থাকেন তাহলে বারবার মেসেজ পাঠাবেন না। কারণ এ ক্ষেত্রে বারবার মেসেজ পাঠানোর কোন কারণ নেই। যেহেতু একবার মেসেজ পাঠানোর মাধ্যমেই তার কাছে আপনার বিয়ের প্রস্তাবটি উপস্থাপিত হয়েছে।
৫. যদি আল্লাহ তাআলা তার সাথে আপনার বিয়ে নির্ধারণ করে না রাখেন; তাহলে তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা ঠিক হবে না। কারণ এ ধরণের উন্মুখতার ভয়াবহতা আপনার অজানা নয়। এটি আপনাকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরিয়ে আনবে। কুরআন মুখস্ত করা ও পুনঃপাঠ থেকে বিরত রাখবে। ইলম অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করবে। অন্তরে নানা রোগ সৃষ্টি করবে। গুনাহর দিকে ধাবিত করবে।
৬. মেসেজ পাঠানোর পূর্বে আমরা আপনাকে ইস্তিখারা করে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। মেসেজ পাঠানোর পর ও প্রস্তাবটি ছেলেকে জানানোর পরও আমরা আপনাকে ইস্তিখারা করার পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ কোন মুসলমান জানে না তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কোথায় রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলমান অজ্ঞ ও অক্ষম। তাই সর্ববিষয়ে জ্ঞানবান ও ক্ষমতাবান প্রতিপালকের কাছে সে দুআ করবে; যেন তিনি তার জন্য নির্বাচন করেন এবং যেখানে কল্যাণ আছে সেটা তার জন্য সহজ করে দেন, যেখানে অকল্যাণ আছে সেটা থেকে তাকে দূরে রাখেন।
৭. জেনে রাখুন, হতে পারে অন্য কোন ছেলে তার চেয়েও উত্তম। তাই আপনি যেহেতু শরয়িতসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে তাকে সংবাদ দিয়েছেন, নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, আল্লাহর কাছে ইস্তিখারা করেছেন; এরপর আল্লাহ আপনাদের দুইজনের মাঝে বিয়ে নির্ধারণ করে রাখেননি; সেক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবেন না। আল্লাহর কাছে দুআ করা ছেড়ে দিবেন না। অন্য প্রস্তাবকারী ছেলেদের মধ্যে চরিত্র ও দ্বীনদারির শর্ত পূরণে কোন ছাড় দিবেন না। ধৈর্যের সাথে আপনার পরিবারের চাপ সয়ে যান। “সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে, নিশ্চয় কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে।[সূরা ইনশিরাহ, আয়াত: ৫-৬]
যদি আপনার মোহরেমদের মধ্যে এমন কেউ থাকে আপনার ভাই বা চাচা… যার সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা আছে, তার সাথে আপনার এ প্রসঙ্গে কথা বলার সুযোগ আছে এবং কথা বললে তিনি দায়িত্ব নিবেন; যেমন অন্য সকল পুরুষ তাদের আত্মীয়াদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রকার অবজ্ঞা ও অস্বীকৃতি ব্যতিরেকে দায়িত্ব পালন করে থাকে; আপনার ক্ষেত্রে এমন কাউকে পাওয়া গেলে বিষয়টি অনেক সহজ হবে। এতে করে আর কোন শংকা থাকে না এবং ইনশাআল্লাহ এটি আপনার জন্যেও প্রশান্তিদায়ক হবে।
আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি তিনি যেন আপনার জন্য এমন কাউকে পাওয়া সহজ করে দেন।
আল্লাহই ভাল জানেন।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব