বিভিন্ন রোগ-বালাই ও মহামারী যেমন "সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা" থেকে সুরক্ষার জন্য কুরআন-সুন্নাহতে কি কোন দোয়া আছে?
রোগ-বালাই ও মহামারী থেকে সুরক্ষার জন্য দোয়া ও যিকির
প্রশ্ন: 139554
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সুন্নাহ-তে এমন অনেক সহিহ হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে যে হাদিসগুলো একজন মুসলিমকে শারীরিক ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে সুরক্ষাপ্রাপ্তির জন্য কিছু দোয়া ও যিকির পড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। যে দোয়া ও যিকিরগুলো নানা রোগ-বালাই ও মহামারী থেকে সুরক্ষাপ্রাপ্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এমন কিছু হাদিস নিম্নরূপ:
১। উসমান বিন আফ্ফান (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: "যে ব্যক্তি তিনবার বলবে:
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
(আমি আশ্রয় চাচ্ছি আল্লাহ্র নামে। যার নামে আশ্রয় চাইলে জমিনে ও আসমানের কোন কিছু ক্ষতি করে না। তিনি হচ্ছেন- সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ) ভোর হওয়া পর্যন্ত সে ব্যক্তিকে কোন আকস্মিক মুসিবত আক্রমন করবে না। আর কেউ যদি সকালে এ দোয়াটি তিনবার বলে তাহলে সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত কোন আকস্মিক মুসিবত তাকে আক্রমন করবে না।"[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ (৫০৮৮)]।
আর তিরমিযি (৩৩৮৮) হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এ ভাষায় এবং বলেছেন হাদিসটি সহিহ: "কোন বান্দা যদি প্রতিদিন সকালে ও প্রতি রাতের সন্ধ্যায় তিনবার বলে:
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
(আমি আশ্রয় চাচ্ছি আল্লাহ্র নামে। যার নামে আশ্রয় চাইলে জমিনে ও আসমানের কোন কিছু ক্ষতি করে না। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।) তাহলে কোন কিছু তার ক্ষতি করবে না।
২। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! গত রাতে এক বিচ্ছুর কামড়ে আমি কী কষ্টই না পাচ্ছি! তিনি বললেন: "সন্ধ্যার সময় তুমি যদি বলতে: أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ (আমি আল্লাহ্র পরিপূর্ণ বাণীসমূহ দিয়ে তিনি অনিষ্টকর যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি) তাহলে তোমার কোন ক্ষতি করত না।"[সহিহ মুসলিম (২৭০৯)]
৩। আব্দুল্লাহ্ বিন খুবাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: এক বৃষ্টিমুখর অন্ধকার রাতে আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সন্ধান করছিলাম আমাদেরকে নামায পড়ানোর জন্য। অবশেষে আমরা তাঁর কাছে পৌঁছতে পারলাম। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন: তোমরা নামায আদায় করেছ? আমি কিছুই বলিনি। এরপর তিনি বললেন: পড়। আমি কিছুই পড়িনি। তিনি পুনরায় বললেন: পড়। এবারও আমি কিছুই বলিনি। পুনরায় তিনি বললেন: পড়। এবার আমি বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমি কি পড়ব? তিনি বললেন: যখন তুমি সন্ধ্যাতে উপনীত হবে ও সকালে উপনীত হবে তখন তিনবার পড়বে: قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (অর্থাৎ সূরা ইখলাস) এবং সূরা ফালাক ও সূরা নাস তাহলে তা সকল অনিষ্ট থেকে তোমাকে রক্ষা করবে।"[হাদিসটি ইমাম তিরমিযি (৩৫৭৫) ও আবু দাউদ (৫০৮২) বর্ণনা করেছেন]
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায (রহঃ) বলেন: "আর যে আমলের মাধ্যমে নিরাপত্তা, সুস্থতা, আত্মপ্রশান্তি ও সকল অনিষ্ট থেকে মুক্তি অর্জিত হয় তাহলো: আল্লাহ্র পরিপূর্ণ বাণীসমূহের মাধ্যমে তিনি ক্ষতিকর যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সে সব থেকে সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার আশ্রয় প্রার্থনা করা: أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
(আমি আল্লাহ্র পরিপূর্ণ বাণীসমূহ দিয়ে তিনি অনিষ্টকর যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।) কারণ হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, এ বাণীটি সুস্থতার জন্য গৃহীত উপায়সমূহের মধ্যে অন্যতম। অনুরূপ দোয়া:
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
(আমি আশ্রয় চাচ্ছি আল্লাহ্র নামে। যার নামে আশ্রয় চাইলে জমিনে ও আসমানের কোন কিছু ক্ষতি করে না। তিনি হচ্ছেন- সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন, যে ব্যক্তি সকালে এ দোয়াটি তিনবার বলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন কিছু তার ক্ষতি করবে না। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় বলবে সকাল হওয়া পর্যন্ত কোন কিছু তার ক্ষতি করবে না।"
এ ধরনের কুরআন ও হাদিসের যিকির ও আশ্রয়প্রার্থনীয় বাণী সকল অকল্যাণ থেকে সুরক্ষা, মুক্তি ও নিরাপত্তার লাভের মাধ্যম। তাই প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য বাঞ্ছনীয় সময়মত এ দোয়াগুলো নিয়মিত পড়া— আল্লাহ্র প্রতি আন্তরিক প্রসন্নতা ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে; যিনি সবকিছুর কর্ণধার, সর্বজ্ঞানী, সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, যিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, প্রতিপালক নেই, যার হাতে রয়েছে সবকিছুর পরিচালনা, উপকার, অপকার ও বঞ্চিতকরণ এবং যিনি সকল কিছুর মালিক।"[ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায (৩/৪৫৪, ৪৫৫)]
৪। আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সন্ধ্যায় উপনীত হতেন ও সকালে উপনীত হতেন তখন তিনি এ দোয়াগুলো পড়া বাদ দিতেন না:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَأَهْلِي وَمَالِي اللَّهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِي وَآمِنْ رَوْعَاتِي اللَّهُمَّ احْفَظْنِي مِنْ بَيْنِ يَدَيَّ وَمِنْ خَلْفِي وَعَنْ يَمِينِي وَعَنْ شِمَالِي وَمِنْ فَوْقِي وَأَعُوذُ بِعَظَمَتِكَ أَنْ أُغْتَالَ مِنْ تَحْتِي
(অর্থ: হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি— দুনিয়া ও আখেরাতের। হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি— আমার দ্বীনদারি ও দুনিয়ার, আমার পরিবার ও সম্পদের। হে আল্লাহ্! আপনি আমার গোপন ত্রুটিসমূহ ঢেকে রাখুন, আমার উদ্বিগ্নতাকে নিরাপত্তায় পরিণত করে দিন। হে আল্লাহ্! আপনি আমাকে হেফাযত করুন আমার সামনের দিক থেকে, আমার পিছনের দিক থেকে, আমার ডান দিক থেকে, আমার বাম দিক থেকে এবং আমার উপরের দিক থেকে। আর আপনার মহত্ত্বের উসীলায় আশ্রয় চাই আমি নীচ থেকে আকস্মিক আক্রান্ত হওয়া থেকে।)[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ (৫০৭৪), ইবনে মাজাহ (৩৮৭১) এবং আলবানী 'সহিহ আবু দাউদ' গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
শাইখ আবুল হাসান আল-মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন:
হাদিসের কথা: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ (হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি): অর্থাৎ দ্বীনিদারির নানা মুসিবত থেকে এবং দুনিয়াবী বিপদাপদ থেকে। কারো কারো মতে, রোগ-বালাই ও বিপদ-মুসিবত থেকে। কারো কারো মতে, বিপদাপদের সম্মুখীন করে এর উপর ধৈর্য রাখা ও এই ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকার পরীক্ষা না করা। الْعَافِيَةَ শব্দটি مصدر (শব্দমূল) কিংবা শব্দটি عافى শব্দ থেকে গঠিত اسم (বিশেষ্য)। 'আল-ক্বামূস' অভিধানে বলা হয়েছে: الْعَافِيَةَ: আল্লাহ্ কর্তৃক বান্দাকে প্রতিরক্ষা দান করা। عافاه الله تعالى من المكروه عفاء ومعافاة وعافية অর্থাৎ আল্লাহ্ তাকে রোগবালাই ও বিপদাপদ থেকে নিরাপত্তা দান করেছেন।
হাদিসের কথা: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ (আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি)। الْعَفْوَ অর্থ পাপমোচন এবং পাপ মাফ করে দেওয়া।
হাদিসের কথা: الْعَافِيَةَ অর্থাৎ দোষত্রুটি থেকে নিরাপত্তা।
হাদিসের কথা: في ديني ودنياي অর্থাৎ দ্বীনি ও দুনিয়াবী বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে।
[মারআতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ (৮/১৩৯)]
৫। আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়ার মধ্যে ছিল:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ زَوَالِ نِعْمَتِكَ ، وَتَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ ، وَفُجَاءَةِ نِقْمَتِكَ ، وَجَمِيعِ سَخَطِكَ
(অর্থ: হে আল্লাহ্! আমি আপনার নেয়ামত দূরীভূত হওয়া থেকে, আপনার দেয়া নিরাপত্তার পরিবর্তন থেকে, আপনার আকস্মিক শাস্তি থেকে এবং আপনার সকল অসন্তুষ্টি থেকে আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি।)[সহিহ মুসলিম (২৭৩৯)]
ইমাম মুনাওয়ি (রহঃ) বলেন:
التحويل অর্থ: কোন কিছুর পরিবর্তন করা এবং অন্য কিছু থেকে সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। যেন বান্দা সর্বক্ষণ নিরাপদ থাকার প্রার্থনা করছে। আর সেটা হচ্ছে সকল প্রকার কষ্ট ও রোগবালাই থেকে নিরাপদ থাকা।[ফায়যুল কাদীর (২/১৪০)]
হাদিসের বাণী: تَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ অর্থ সুস্থতা অসুস্থতা দিয়ে পরিবর্তিত হওয়া এবং স্বচ্ছলতা দারিদ্র দিয়ে পরিবর্তিত হওয়া।[আওনুল মাবুদ শারহু সুনানে আবি দাউদ (৪/২৮৩)]
৬। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْبَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئْ الْأَسْقَامِ
(অর্থ: হে আল্লাহ্! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেতী রোগ, পাগল হওয়া, কুষ্ঠরোগ ও সকল খারাপ রোগ থেকে)।[মুসনাদে আহমাদ (১২৫৯২), সুনানে আবু দাউদ (১৫৫৪), সুনানে নাসাঈ (৫৪৯৩); আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
ইমাম ত্বীবী বলেন: "তিনি সাধারণভাবে সকল রোগ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। কারণ কিছু রোগ আছে অস্থায়ী। এতে কষ্ট হালকা; কিন্তু ধৈর্য ধরলে এর সওয়াব অধিক; যেমন- জ্বর, মাথা ব্যথ্যা, চোখ ওঠা। বরঞ্চ তিনি দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। যে রোগগুলোর কারণে ঘনিষ্ঠজন দূরে সরে যায়, সমবেদনা জানানো ও চিকিৎসা দেয়ার লোক কমে যায় এবং দুর্নাম ছড়ায়।”[আল-আযীম আবাদী "আওনুল মাবুদ" গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব