ইসলামে ব্যক্তি নিজে নিজের চিকিৎসা করা সংক্রান্ত কিছু বিধি-বিধান আমি জানতে চাই। আমি বিয়ের পর একটি কঠিন সময় অতিবাহিত করছি। আমার স্বামী আমাকে অবহেলা করে। আমি ঠিক জানি না যে, এটা কি ইচ্ছা করে করে; নাকি অনিচ্ছাকৃত। সারাদিন সে তার কম্পিউটার ও মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকেÑ গেইম খেলে, বন্ধুদের সাথে অনবরত কথা বলে যায়। আমি তার সাথে একটি কথা বলারও অধিকার রাখি নাÑ যাতে করে তাকে তার মোবাইল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না হয়। সারাদিনে সে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা অবিচ্ছিন্নভাবে আমার সাথে সময় কাটায়। বিগত দুই বছরে এই ইস্যু নিয়ে আমরা অনেক ঝগড়াঝাটিতে জড়িয়েছি। কিন্তু শেষে আমি ধৈর্য ধরার এবং চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আমি বিষণ্ণতা, প্রত্যাখ্যান, দুঃখ ও একাকীত্ব অনুভব করছি। আমি ঘুমাতে পারছি না। তাই আমি Muscle relaxant (পেশী শ্লথন) খাচ্ছি; যে প্রকারটি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু আমি এখন অনুভব করছি যে, আমি এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। আমার মাঝে অনেক হতাশা, উদ্বিগ্নতা রয়েছে। কিন্তু এই Muscle relaxant (পেশী শ্লথন) খাওয়ার সাথে সাথে আমি ঘুমিয়ে পড়ি এবং শান্ত হয়ে জেগে উঠি। কোন ডাক্তার আমাকে এই ঔষধ লিখে দেননি। আমার ভালভাবে ঘুমাতে না পারার ইতিহাস রয়েছে। আমি এই ঔষধগুলো মাঝে মাঝে ব্যবহার করি। এই ঔষধটি এক ডোজ খাওয়ার ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে এর ইফেক্ট শুরু হয় এবং চার থেকে ছয় ঘণ্টা এর প্রভাব থাকে। কিন্তু এর পরেও এই ঔষধ আমাকে মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে প্রশান্ত রাখে। আমি জানি যে, ইসলামে মাদকদ্রব্য সেবন হারাম। আমার নিজের সিদ্ধান্তে এই ট্যাবলেটগুলো গ্রহণ করার কারণেও কি আমার ৪০ দিনের নামায কবুল হবে না?
উদ্বেগ ও অনিদ্রার চিকিৎসা হিসেবে প্রশান্তিদায়ক ও ঘুমের ঔষধ ব্যবহারের হুকুম
প্রশ্ন: 297773
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
এক:
স্বামীর উপর স্ত্রীর কিছু প্রাপ্য অধিকার রয়েছে। যেমন– ভাল আচরণ করা, ভরণপোষণ ও বাসস্থান দেয়া, সতিত্ব টিকিয়ে রাখানো, আবেগ–অনুভূতির চাহিদা পূরণ। এ অধিকারগুলোর পক্ষে কুরআন–সুন্নাহর দলিল রয়েছে।
অনুরূপভাবে স্ত্রীর উপরও স্বামীর কিছু প্রাপ্য অধিকার রয়েছে। যেমন– ভাল আচরণ, যথাযথ ক্ষেত্রে আনুগত্য করা, উপভোগ করার সুযোগ দেয়া, স্বামীর সেবা করা, স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাসার বাইরে না যাওয়া। ইতিপূর্বে 10680 নং প্রশ্নোত্তরে এই অধিকারগুলো বর্ণনা করা হয়েছে।
আপনার স্বামী আপনার প্রতি অমনোযোগী মর্মে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সেটার সমাধান হলো পারস্পারিক বুঝাপড়া এবং উভয়ের জন্য উপযুক্ত কিছু কাজ খুঁজে বের করা। যেমন- ইলমে দ্বীন হাছিল করা, কুরআনে কারীম মুখস্ত করা, অবসর সময়ে ঘুরতে বের হওয়া এবং মোবাইল এর ব্যবহার কমানো ইত্যাদি।
দুই:
ঘুমের ঔষধ ও প্রশান্তিদায়ক ঔষধ নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা নাজায়েয। কেননা এ ঔষধগুলোর মধ্যে কোন কোনটিতে মাদকদ্রব্য রয়েছে। কোন কোনটির সেবন এক পর্যায়ে নেশাগ্রস্ততায় পর্যবসিত হয়। আর কোন কোনটির উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি।
তাই এ ধরণের ঔষধ গ্রহণে নিজের থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া উপরোক্ত কারণে নিষিদ্ধ।
শাইখ ইবনে উছাইমীন (রহঃ)–কে জিজ্ঞেস করা হয়: ঘুমের ঔষধ কিংবা যেটাকে প্রশান্তিদায়ক ঔষধ বলা হয় সেটার হুকুম কি? এটি কি মাদকদ্রব্যের অধীনে পড়বে; নাকি পড়বে না? যদি জরুরী হয়ে পড়ে কিংবা ডাক্তার পরামর্শ দেয় সেক্ষেত্রে কি এটি গ্রহণ করা জায়েয হবে?
তিনি জবাব দেন: এই ঔষধগুলো সেবন করা নাজায়েয। তবে যদি প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে একজন বিজ্ঞ সমঝদার ডাক্তারের অনুমতিপ্রাপ্তির শর্তে জায়েয আছে। কেননা এই ঔষধগুলো বিপদজনক। মস্তিস্কের উপর এগুলোর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি এই ঔষধগুলো ব্যবহার করে ঐ সময় সে শান্ত ও কোমল হয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে এর চেয়ে গুরুতর অনিষ্ট ঘটে। যা জানা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো প্রয়োজন হলে এই ঔষধগুলো ব্যবহার করা জায়েয আছে। তবে শর্ত হলো ডাক্তারের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ মাফিক হতে হবে।[ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (ক্যাসেট নং ৮২/প্রথম পিঠ)]
তিন:
যে ঔষধগুলোতে কিঞ্চিত মাদকদ্রব্য রয়েছে এসব ঔষধের মূল বিধান হলো হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়া। কিন্তু যদি চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমন কোন ঔষধ ব্যবহার করা সুনির্দিষ্ট হয়ে পড়ে এবং এর স্থলাভিষিক্ত অন্য কোন বৈধ ঔষধ না থাকে সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে এসব ঔষধ ব্যবহার করা জায়েয:
১। রোগীর জন্য এই ঔষধটি ব্যবহার করার চাহিদা জরুরী অবস্থা কিংবা তীব্র প্রয়োজনের পর্যায়ে পৌঁছা।
২। একজন নির্ভরযোগ্য মুসলিম ডাক্তার সাক্ষ্য দেয়া যে, মাদকদ্রব্য সম্বলিত এই ঔষধটিতে রোগীর জন্য উপকার রয়েছে।
৩। এই ঔষধটির ততটুকু পরিমাণ ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যতটুকু ব্যবহারের মাধ্যমে জরুরী প্রয়োজন মিটে যাবে।
৪। এই ঔষধটি ব্যবহারের ফলে রোগীর আরও অধিক ক্ষতি না হওয়া কিংবা যে ক্ষতির কারণে ব্যবহার করা হয়েছে এর সম পর্যায়ের ক্ষতি না ঘটা।
আপনার জন্য পরামর্শ হচ্ছে– আপনি যে ঔষধটি ব্যবহার করছেন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সাধারণভাবে ঔষধের ব্যবহার কমিয়ে দিন এবং আপনার বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতার চিকিৎসা শরয়ি উপায়ে করুন; যেমন– কুরআন তেলাওয়াত করা, আল্লাহ্র যিকির করা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠ করা। এগুলোর মাধ্যমে আপনার অন্তর প্রশান্ত থাকবে এবং দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।”[সূরা রাদ, ১৩:২৮]
এবং উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন রাতের দুই-তৃতীয়াংশ পার হয়ে যেত তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়াতেন এবং বলতেন: “হে লোক সকল! আল্লাহকে স্মরণ কর। কম্পনকারী (প্রথম ফুৎকার) চলে এসেছে এবং তাকে অনুসরণ করবে তার অনুবর্তী (দ্বিতীয় ফুৎকার)। মৃত্যু তার ভয়াবহতা নিয়ে হাজির। মৃত্যু তার ভয়াবহতা নিয়ে হাযির।” উবাই বলেন: আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার উপর বেশি বেশি দুরূদ পড়ি। অতএব, আমি আপনার প্রতি দরূদ পড়ার জন্য (দোয়ার) কতটা সময় নির্দিষ্ট করব?’ তিনি বললেন: “তুমি যতটুকু ইচ্ছা কর।” আমি বললাম: ‘এক-চতুর্থাংশ?’ তিনি বললেন: “যতটা চাও। যদি তুমি বেশি কর তবে তা তোমার জন্য উত্তম হবে।” আমি বললাম: ‘অর্ধেক (সময়)?’ তিনি বললেন: “তুমি যা চাও; যদি বেশি কর, তাহলে তা তোমার জন্য ভাল।” আমি বললাম: ‘দুই-তৃতীয়াংশ?’ তিনি বললেন: “তুমি যা চাও (তাই কর)। যদি বেশি কর তবে তা তোমার জন্য উত্তম।” আমি বললাম: ‘আমি আমার (দোয়ার) সম্পূর্ণ সময় দুরূদের জন্য নির্দিষ্ট করব!’ তিনি বললেন, “তাহলে তোমার দুশ্চিন্তা দূর করা হবে এবং তোমার পাপ মোচন করা হবে।”[সুনানে তিরমিযি (২৪৫৭); আলাবানী হাদিসটিকে ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে ‘হাসান’ বলেছেন]
তুহফাতুল আহওয়াযি গ্রন্থে বলা হয়েছে: “আমি আপনার প্রতি দরূদ পড়ার জন্য (দোয়ার) কতটা সময় নির্দিষ্ট করব?” অর্থাৎ ‘আমি আমার নিজের জন্য দোয়ার বদলে’ মোল্লা আলী ক্বারী এভাবে বলেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দুরুদ পড়া অন্তর প্রসন্ন হওয়া, মন ভালো হওয়া, দুশ্চিন্তা দূর হওয়ার মহান উপায়।
আমরা আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আপনার স্বামীকে সংশোধন করে দেন এবং আপনার দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা দূর করে দেন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব