অন্যসব দিনের উপর যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের কি বিশেষ ফযিলত আছে? এই দশদিনে যে নেক আমলগুলো বেশি বেশি পালন করা মুস্তাহাব সেগুলো কি কি?
যিলহজ্জের দশদিনের ফযিলত
প্রশ্ন: 49042
আলহামদুলিল্লাহ ও রাসুলে আল্লাহ ও তাঁর পরিবারের উপর সালাম ও প্রশংসা
যিলহজ্জের প্রথম দশদিন ইবাদতের মহান মৌসুম। আল্লাহ তাআলা বছরের অন্যসব দিনের উপর এ দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “অন্য যে কোন সময়ের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর তথা দশদিনের নেক আমল অধিক প্রিয়। তারা (সাহাবীরা) বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়!! তিনি বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়; তবে কোন লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোন কিছু নিয়ে ফেরত না আসে সেটা ভিন্ন কথা।”[সহিহ বুখারী (২/৪৫৭)]
তাঁর থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “আল্লাহর কাছে ঈদুল আযহার দশদিনে পালনকৃত নেক আমলের চেয়ে অধিক পবিত্র ও অধিক সওয়াবের অন্য কোন আমল নেই। জিজ্ঞেস করা হল- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়? তিনি বললেন: না; আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে কোন লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোন কিছু ছাড়া ফেরত আসে।”।[সুনানে দারেমী (১/৩৫৭); হাদিসটির সনদ সহিহ, যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (৩/৩৯৮)]
এ সকল দলিল ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ করে যে, এ দশটি দিন বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়ে উত্তম; এমনকি রমযানের শেষ দশ দিবসের চেয়েও উত্তম। তবে, রমযানের শেষ দশরাত্রি যিলহজ্জের দশরাত্রির চেয়ে উত্তম; যেহেতু ঐ রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর আছে, যে রাতটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম।[দেখুন: তাফসীরে ইবনে কাছীর (৫/৪১২)]
তাই একজন মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে- খাঁটি তওবা করার মাধ্যমে এ দিনগুলো শুরু করা। এরপর এ দিনগুলোতে অধিক হারে সাধারণ সকল নেক কাজ করা এবং নিম্নোক্ত আমলগুলোর উপর গুরুত্ব দেয়া:
১. রোযা রাখা: যিলহজ্জ মাসের (প্রথম) ৯ দিন রোযা রাখা মুসলিমের জন্য সুন্নত। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দশদিনে নেক কাজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। রোযা রাখা নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত। রোযাকে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য নির্বাচন করেছেন। হাদিসে কুদসীতে এসেছে- “বনী আদমের সকল আমল তার নিজের জন্য শুধু রোযা ছাড়া। রোযা আমারই জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দিব।”[সহিহ বুখারী (১৮০৫)]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলহজ্জ মাসের ৯ দিন রোযা রাখতেন। হুনাইদা বিন খালিদ থেকে তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জনৈক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলহজ্জ মাসের (প্রথম) ৯ দিন, আশুরার দিন ও প্রতিমাসে তিনদিন রোযা রাখতেন। মাসের প্রথম সোমবার ও প্রথম দুই বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।[সুনানে নাসাঈ (৪/২০৫) ও সুনানে আবু দাউদ, আলবানী সহিহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (২/৪৬২) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
২. বেশি বেশি আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পড়া: কেননা এ দশদিনে তাকবীর দেয়া, আলহামদুলিল্লাহ পড়া, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও সুবহানাল্লাহ পড়া সুন্নত। মসজিদে, বাড়ীঘরে ও সর্বস্থানে উচ্চস্বরে এগুলো পড়া। এর মাধ্যমে প্রকাশ্যে আল্লাহর ইবাদত পালন করা হয় ও আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
এগুলো পুরুষেরা প্রকাশ্যে পড়বে; আর নারীরা গোপনে পড়বে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসেবে দিয়েছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে পারে”[সূরা হজ্জ, আয়াত: ২৮] জমহুর আলেমের মতে, ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ হচ্ছে- যিলহজ্জের দশদিন। দলিল হচ্ছে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত উক্তি: “নির্দিষ্ট দিনগুলো হচ্ছে- যিলহজ্জের দশদিন।” ইবনে উমর (রাঃ) থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “আল্লাহর কাছে এ দশদিনের চেয়ে অধিক মহান ও আমল করার জন্য অধিক প্রিয় আর কোন দিন নেই। সুতরাং তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ পড়।”[মুসনাদে আহমাদ (৭/২২৪), আহমাদ শাকের এ সনদটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
তাকবীর বলার পদ্ধতি হচ্ছে- ‘আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’; এ ছাড়াও আরও কিছু পদ্ধতি বর্ণিত আছে।
বর্তমানে মানুষ এ দিনগুলোতে তাকবীর দেয়ার সুন্নত পালন করে না। বিশেষত যিলহজ্জ মাসের প্রথম দিকে আপনি খুবই কম সংখ্যক লোককে তাকবীর দিতে শুনবেন। অতএব, এ সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করতে ও গাফেলদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে উচ্চস্বরে তাকবীর দেয়া বাঞ্ছনীয়। ইবনে উমর (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে সাব্যস্ত আছে যে, যিলহজ্জের দশদিনে তাঁরা দুইজন বাজারে গিয়ে তাকবীর দিতেন এবং তাঁদের তাকবীর শুনে লোকেরাও তাকবীর দিত। অর্থাৎ লোকদের তাকবীরের কথা স্মরণ হত; তখন প্রত্যেকে নিজে নিজে তাকবীর দিত। এর দ্বারা দলবদ্ধভাবে একই সুরে তাকবীর দেয়া উদ্দেশ্য নয়; কেননা সেটা শরিয়তসম্মত নয়।
কোন বিস্মৃত সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করা ও এতে প্রভূত সওয়াব থাকার দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর মৃতপ্রায় কোন সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করবে সে ব্যক্তি ঐ সুন্নতটির উপর আমলকারীদের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; কিন্তু, আমলকারীর সওয়াব থেকে কোন কিছু কমানো হবে না।”।[সুনানে তিরমিযি (৭/৪৪৩); অন্যান্য হাদিসের কারণে এটি ‘হাসান’ হাদিস]
৩. এ দিনগুলোতে হজ্জ ও উমরা পালন করা: এ দিনগুলোতে সবচেয়ে উত্তম আমল হচ্ছে- বায়তুল্লাহ- হারামের হজ্জ আদায় করা। আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তিকে তাঁর ঘরের হজ্জ আদায় করার তাওফিক দিয়েছেন সে ব্যক্তি যদি যথাযথভাবে সে হজ্জ আদায় করে তাহলে সে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীতে বর্ণিত প্রতিদানের অংশীদার হবে: “মাবরুর হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়”।
৪. কোরবানী করা: এ দশদিনের নেক আমলের মধ্যে রয়েছে- কোরবানীর পশুকে মোটাতাজা করা, হৃষ্টপুষ্ট করা ও জবাই করা এবং আল্লাহর রাস্তায় মাল খরচ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা।
অতএব, আসুন যেই দিন অবহেলাকারী আফসোস করবে সেই দিনের পূর্বে এবং যেই দিন সে দুনিয়ায় ফিরে আসার প্রার্থনা করবে; কিন্তু প্রার্থনা কবুল করা হবে না সেইদিনের পূর্বে আমরা এ মর্যাদাপূর্ণ দিনগুলোকে কাজে লাগাই।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব